Views Bangladesh Logo

এক বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আদৌ ‘সরকার’ হয়ে উঠতে পেরেছে কি?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির ঠিক দুদিন আগে গত ৩ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষণার জন্য আয়োজিত সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির একাধিক নেতার বক্তব্যে গত এক বছরে নানা ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তিজনিত নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশিত হয়। অথচ এনসিপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন হিসেবে মনে করা হয়। সরকার নিজেও বিভিন্ন সময় বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এই দলটির প্রতি তাদের বিশেষ পক্ষপাত বা সমর্থন রয়েছে। এর একটি কারণ হয়তো এই যে, এনসিপি গঠিত হয়েছে এমন কিছু তরুণের উদ্যোগে যারা জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে ছিলেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থাকা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও কয়েকদিন আগে রাজধানীতে এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘এখনো শেখ হাসিনা সরকারের মতোই স্বৈরতন্ত্র, একই রকম জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, একই রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সরকারের এই উল্টোযাত্রা চলতে থাকলে জনগণের দ্রোহযাত্রা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে।’

প্রশ্ন হলো, অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা মানুষজনই কেন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারের এমন সমালোচনায় মুখর হলেন? সরকার কি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলো? সরকারের সঙ্গে কি এক বছরেরও জনগণের সম্পর্ক তৈরি হলো না?

জুলাইয়ের আন্দোলনের নারী-পুরুষ সবাই সামনের সারিতে ছিলেন। তাদের মধ্যে একাধিক নারী আইকনিক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। অথচ অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা অনেক নারী এখন বৈষম্য, মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ করছেন। কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে বেরিয়েও গেছেন। অভিযোগ করেছেন খোদ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই।

গত এক বছরে নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধ করে দেয়াসহ নানাভাবে নারীকে পিছিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে। কথিত তৌহিদী জনতার নামে নারীবিরোধী ও নারীবিদ্বেষী অনেক ঘটনা ঘটেছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কার্যত বাতিল। কেননা এই কমিশনের কিছু সুপারিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সমাবেশ করেছে। কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়েছে; কিন্তু নারী নিগ্রহ, নির্যাতন ও বৈষম্যের ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে খুব জোরালো কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উপরন্তু বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও দলের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ পক্ষপাত ও সমীহ নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশে দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের ঘটনায় তিনি উদ্বিগ্ন। খ্যাতিমান লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরও বলেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে জামায়াতের প্রভাব বেড়েছে।

সুতরাং এসব ঘটনায় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল এবং একটি অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে যে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো, এক বছরেও তারা কেন রাষ্ট্রে বৈষম্য নিরসনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারলো না? উপরন্তু নারীদের প্রতি বৈষম্য ও নিগ্রহ কেন আগের মতোই রয়ে গেছে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন বাড়ল? অভ্যুত্থানের পর কেন ধর্মীয় রাজনীতি ও গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়লো আর অন্তর্বর্তী সরকারই বা কেন এই শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বা তাদের কেন সমীহ করছে?

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার চেষ্টা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের দল এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, যারা এই অপচেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারী তরুণদের দলও রয়েছে। ফলে তাদের ইনটেনশন বা নিয়ত ও রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বস্তুত, গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই তরুণদের প্রতি দল-মত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল, সেখানে বড় ধরনের চিড় ধরেছে। তাদের কার্যক্রম, দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ও শরীরী ভাষা দেখে মনে হয় না তারা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনস্তত্ত্ব ও পালস বোঝেন। উপরন্তু এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মবে নেতৃত্ব দেয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। হাতেনাতে ধরাও পড়েছেন অনেকে। ফলে অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা লোকজনের এই নৈতিক স্খলন; নারীদের পিছিয়ে রাখার অপচেষ্টা; ধর্মীয় কট্টরপন্থি, উগ্রবাদী ও কথিত তৌহিদী জনতার আস্ফালন জুলাই অভ্যুত্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হলেও এর স্পিরিট বা দর্শন ছিল বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। সেই বৈষম্য শুধু যে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বা যৌক্তিক সংস্কার তাই নয়, বরং নারীর প্রতি পুরুষের খবরদারিসুলভ মানসিকতা এবং নারীকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতারও অবসান। একই সঙ্গে রাজনীতি ও মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে ব্যক্তির ওপর আক্রমণ বন্ধ করা এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

হাটেবাজারে, রাস্তায়, বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনালসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অবসান; সরকারি অফিসে ঘুষ ও দুর্নীতির মূলোৎপাটনের প্রত্যাশাও জুলাই অভ্যুত্থানের পেছনে নানাভাবে ভূমিকা রেখেছে; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এই দাবি করতে পারবে না যে, গত এক বছরে তারা কোনো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করা তো দূরে থাক, অন্তত দুর্নীতি ও নাগরিক হয়রানির মাত্রা কমিয়ে আনতে পেরেছে। উপরন্তু ‘ঘুষের রেট’ আগের চেয়ে বেড়েছে বলে শোনা যায়। চাঁদাবাজি কোথাও কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য খবর আসছে। আগে যেমন চাঁদাবাজির অভিযোগ আসতো একটি দলের বিরুদ্ধে, এখন এই অভিযোগ আসছে অন্য একাধিক দলের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ সিস্টেম আগের মতোই চলছে। শুধু চেহারায় বদল। অনিয়ম-দুর্নীতি-ঘুষ ও নাগরিক হয়রানি যদি আগের মতোই চলতে থাকে তাহলে শুধু অপরাধীর চেহারা বদলের জন্য নিশ্চয়ই এত বড় একটি অভ্যুত্থান হয়নি। অতীতের রাজনৈতিক সরকার বিভিন্ন দলীয় ও পারিবারিক স্বার্থে যেসব অন্যায় বন্ধ করেনি বা করতে পারেনি, সেই একই অন্যায় এখন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও চলতে থাকলে অভ্যুত্থানের সফলতা কোথায়?

গত এক বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে মব সন্ত্রাস প্রতিহত করতে না পারার কারণে। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে এই সময়ের বাংলাদেশকে ‘মবের মুল্লুক’ বলেও মন্তব্য করেছেন- যা একজন শান্তিতে নোবেলজয়ী সরকার প্রধানের জন্য স্পষ্টতই অসম্মানের, লজ্জার। সরকার যে মব সন্ত্রাস প্রতিহত করতে খুব কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে, সেই দাবিও করতে পারবে না। উপরন্তু সরকারের কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি মবকে বৈধতা দেয়ার জন্য একে ‘প্রেশার গ্রুপ’ বা ‘জনরোষ’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশে এর আগে আরও অনেক মব হয়েছে; বাংলাদেশের প্রথম সবচেয়ে বড় মব হয়েছে বিহারিদের বিরুদ্ধে- এরকম মন্তব্যও এসেছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তরফে। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেকের মনে এই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, সরকার নিজেই কি তাহলে মব উসকে দিচ্ছে?

অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই দাবি করে আসছে যে, গণমাধ্যমের ওপর কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় চাপ নেই; কিন্তু সোমবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে বিভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এই সময়ে ২৬৬ জন সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং ১১টি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে, অন্তত ১৫০ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মব তৈরি করে গণমাধ্যম কার্যালয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তিন দফায় ১৬৭ জনের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা যায়নি।

কোনো একটি দেশে একসঙ্গে আড়াইশর বেশি সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামি- এটি বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। যদি তাই হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করা যেত; কিন্তু সেটি না করে গণহারে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে তাদের মাসের পর মাস কারাগারে রাখা হয়েছে। সরকার যদিও বলছে যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার দায় তাদের নয়। কেননা এসব মামলার বাদী পুলিশ নয়; কিন্তু তা সত্ত্বেও গায়েবি ও অবিশ্বাস্য অভিযোগে দায়ের করা মামলায় কারাবন্দি আড়াইশর বেশি সাংবাদিকের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে সরকারের কোনো আন্তরিক পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বরং সরকার হয়তো ভাবছে যে, এসব সাংবাদিককে জামিনে মুক্তি দিলে উল্টো সরকার নিজেই সমালোচনা বা মবের শিকার হবে।

গত এক বছরে বিভিন্ন পেশাজীবী ও নাগরিকদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত মব ও ট্যাগিং। সরকারের আচরণে মনে হয় তারা নিজেরাও এসব নিয়ে ভীত। অর্থাৎ সরকার নিজেই যদি কোনো একটি গোষ্ঠী বা দলের আচরণ ও তৎপরতাকে ভয় পায় বা ভয় পেতে বাধ্য হয় তাহলে সেই সরকারের পক্ষে নাগরিকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে এক বছরেও এই সরকার আদৌ ‘সরকার’ হয়ে উঠতে পেরেছে কি না, সেই প্রশ্নটিই জোরেশোরে উঠছে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ