ছোটগল্প
হরিদাস পাল
মাতৃভাষা কেন্দ্রের বাৎসরিক ভাষা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নতুন কোনো কথা বললেন না, বাড়তি কোনো কথাও না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত যে বক্তব্যটি দেয়া হয়েছিল, হুবহু সেটিই পাঠ করলেন। ভাষাশহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করলেন, সভ্যতার উৎকর্ষে ভাষার অবদানের কথা বললেন, আদর্শ নাগরিক গঠনে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা সম্পর্কে বললেন এবং সময়ের ব্যবধানে এই ভাষা উৎসব যে এখন ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে, সেসব কথা বললেন।
অনুষ্ঠান শেষে এসএসএফ পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি গেলেন কেন্দ্রের মাঠে। উদ্বোধন করবেন মাঠের মাঝখানে স্থাপিত পাঁচ ভাষা শহীদের ভাস্কর্য, যার নাম রাখা হয়েছে ‘আ মরি বাংলা ভাষা।’ সঙ্গে আছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী, সচিব, কেন্দ্রের সভাপতি, মহাপরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। আরও আছেন তরুণ ভাস্কর তুহিন মাহমুদ। তার চেহারায় প্রতিদিনের সেই গাম্ভীর্য নেই। সবসময় সে গাম্ভীর্য বজায় রাখে। কেননা সে একজন সুপরিচিত শিল্পী, তার ওপর মাতৃভাষা কেন্দ্রের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের অফিসার। শিল্পীদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখতে হয়। নইলে সাধারণের কাছ থেকে তাকে আলাদা করা যায় না; কিন্তু আজ সে দারুণ প্রফুল্ল। হওয়ারই কথা। তার তৈরি ভাস্কর্য উদ্বোধন করবেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি, বড় আনন্দের ব্যাপার আর কী আছে! লাল পাঞ্জাবি আর সাদা সুইস পায়জামায় তাকে অপূর্ব লাগছে। মনে হচ্ছে বয়স ছত্রিশ নয়, ত্রিশ। কপালটা এমনিতেই প্রশস্ত। লম্বা চুলে ঝুটি বাধায় দ্বিগুণ প্রশস্ত লাগছে। মুখে ছড়িয়ে থাকা গর্বের ছাপ কপাল ছুঁয়েছে।
ভাস্কর্যগুলো কালো পর্দায় ঢাকা। সামনে টানানো উদ্বোধনের লাল ফিতা। প্রধানমন্ত্রী প্রথমে ফিতা কাটলেন, তারপর ফিতা টেনে কালো পর্দা সরিয়ে উন্মোচন করলেন দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য। উঠল মুহুর্মুহু করতালি। সবাই যখন করতালি দিচ্ছিল তিনি তখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভাস্কর্যের নিচে এবং পেছনের দেয়ালের টেরাকোটার নকশাগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। প্রবীণ মহাপরিচালক বললেন, এমন নকশা দেয়ালের পেছনটাতেও আছে স্যার। চমৎকার কাজ করেছে তুহিন।
প্রধানমন্ত্রী ঘুরে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাড়ি পরা এক মায়ের নকশাটি দেখে বলে উঠলেন, অপূর্ব! অতি চমৎকার!
মহাপরিচালক উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ভাষা শহীদদের এমন রিয়েলিস্টিক ভাস্কর্য বা টেরাকোটার এমন চমৎকার নকশা দেশে আর কোথাও নেই। মোট তের লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এক বেসরকারি কোম্পানি দিয়েছে ১০ লাখ। বাকিটা কেন্দ্রের তহবিল থেকে খরচ করা হয়েছে।
শিল্পীকে উপযুক্ত সম্মানী দেয়া হয়েছে তো? কী অসাধারণ নির্মাণ! আমি সত্যি মুগ্ধ।
জি, দেয়া হয়েছে। তিনি কেন্দ্রেরই কর্মকর্তা। গুণী শিল্পী।
কোথায় তিনি?
তুহিন পেছনেই ছিল, এগিয়ে এলো সামনে। মহাপরিচালক তার পিঠে হাত রেখে বললেন, এই যে স্যার, ইনি। তুহিন মাহমুদ। আমাদের গর্ব।
প্রধানমন্ত্রী হাত বাড়িয়ে দিলেন। হ্যান্ডশেক করে বললেন, ভাস্কর্য এতটা জীবন্ত হতে পারে আপনার কাজ দেখে বুঝতে পারলাম। কংগ্রাচুলেশন! নিঃসন্দেহে অসাধারণ কাজ। আন্তোনিও ক্যানোভার সাইকি রিভাইভড বাই লাভ’স কিস দেখে আমি ঠিক এমনই মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওটা মার্বেলের ছিল। এগুলো তো পিতলের, তাই না?
জি স্যার, পিতল। তুহিন বলল।
কদিন লেগেছে বানাতে?
তা প্রায় আট মাস লেগে গেছে স্যার।
অনেক পরিশ্রম করেছেন।
মিছা কথা স্যার। -পেছন থেকে বলে উঠল কেউ একজন। সবার দৃষ্টি ফিরল সেদিকে। পুকুরঘাটে দেখতে পেল এক লোককে, যার পরনে জীর্ণ প্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট, তার ওপর কালো চাদর এবং মুখে নাড়ার মতো কাঁচাপাকা দাড়ি।
দুই পা এগিয়ে লোকটি বলল, এসব তুহিনবাবুর মিছা কথা স্যার। এগুলা তার বানানো না, আমার বানানো। নিজ হাতে বানাইছি। বানাতে তিন মাস লাগছে। কোনো পরিশ্রম হয় নাই। আনন্দের কাজে কি স্যার পরিশ্রম হয়? হয় না। তুহিনবাবু আমার কাজ নিজের নামে চালায়া দিতেছেন, এটা অন্যায় স্যার।
মহাপরিচালকের চোখেমুখে বিস্ময়। কে এই লোক? এখানে এলোইবা কী করে? তিনি ধমকে উঠলেন, কে আপনি?
আমি হরি। রোয়াইলের হারিদাস পাল।
কী বলতে চাইছেন আপনি?
হরিদাস পাল কয়েক পা সামনে এগোল। চট করে দুই এসএসএফ সদস্য দাঁড়িয়ে গেল তার দুই পাশে। হাত বাড়িয়ে তারা যখন তাকে আটকাতে যাচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী তখন হাত তুলে বললেন, তাকে আসতে দাও। এসএসএফ সদস্যরা খানিকটা সরে দাঁড়াল। হরিদাস পাল আরো কয়েক পা এগিয়ে বলল, বলতে চাইছি এসব মূর্তি আর নকশা আমার বানানো। মন-প্রাণ ঢাইলা খুব যত্ন কইরা বানাইছি স্যার। যখন বরকতের মূর্তিটা বানাইতেছিলাম, এতটাই মগ্ন হয়া গেছিলাম, আমার মনে হইতেছিল বরকত জ্যান্ত হয়া উঠছেন, তিনি আমার লগে কথা বলছেন। আর যেদিন সালামের মূর্তিটা বানানি শেষ হইল সেদিন রাইতে আমি তারে খোয়াবে দেখলাম। একই বাসে কইরা আমরা দূরে কোথাও যাইতেছি। আচমকা তিনি নাইমা গেলেন এক চৌরাস্তার মোড়ে। বাস ছুটে চলছে জোর গতিতে। জানালা দিয়া মাথা বাইর কাইরা আমি তারে ডাকছি; কিন্তু রাস্তায় গাড়িঘোড়ার শব্দে তিনি আমার ডাক শুনতে পাইতেছেন না।
মহাপরিচালক ধমকে উঠলেন, কীসব প্রলাপ বকছেন! আপনি এখানে ঢুকলেন কেমন করে?
হরিদাস হাসল। ডান হাতে দাড়ি চুলকাল। তারপর বলল, স্যার, আমি জানতাম এইখানে যে আমি ঢুকতে পারমু না, ঢুকতে আমারে দেয়া হবে না। তাই গতকালই ঢুইকা পড়ছি। সারা রাইত ছাদে ছিলাম। গোয়েন্দা লোকেরা যখন ছাদ চেক করতে গেছিল, আমি সানশেডে লুকায়া ছিলাম। তারা আমারে দেখতে পায় নাই। দেখতে পাইলে এখন আমি জেলখানায় থাকতাম। ভগবানের দয়ায় বাঁইচা গেছি।
কী আশ্চর্য! মহাপরিচালকের চোখেমুখে দ্বিগুণ বিস্ময়।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, দেখে তো মনে হচ্ছে আর্টিস্ট। ব্যাপারটা কী বলুন তো? আপনার বাড়ি কোথায়?
হরিদাস বলল, না না স্যার, আমি কোনো আর্টিস্ট না স্যার। আমি সাধারণ, খুবই সাধারণ একজন মানুষ। পেশায় আমি কুমোর। ধামরাইয়ের রোয়াইলে আমার বাড়ি। আমার বাপ কুমোর ছিল, দাদা কুমোর ছিল। জন্মের পর থেকে দেখছি তারা মহাদেবের মূর্তি গড়ছেন, দেবী দুর্গা আর সরস্বতির প্রতিমা গড়ছেন। আমার মন ঐদিকে টানল, আমিও ঐ লাইনে ঢুইকা পড়লাম। লেখাপড়া বেশি করি নাই, মাত্র ক্লাস টু পাস। ইংরাজি বায়ান্ন সালে স্যার, সেই বায়ান্ন সালের ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ, পাকিস্তানি পুলিশ যেদিন ছাত্রদের ওপর গুলি চালাইল, আমার বাপ সেদিন রমনা কালীমন্দিরে আইছিল সরস্বতীর একটা প্রতিমা নিয়া। তার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটছিল স্যার। তিনি নিজ চোখে দেখছেন। ছোটবেলায় আমারে সেই ঘটনার কথা কইছিলেন। ঘটনাটা আমার মনে দাগ কটছিল স্যার। আমি যখন এই মূর্তিগুলা বানাইতেছিলাম, মনে হইতেছিল তাদের সবাইরে আমি চিনি। আগে কোথাও দেখছি। তুহিনবাবু তাদের যে ছবিগুলান আমারে দিছিলেন, সেসব ছবির সাথে আমার কল্পনার ছবি মিলে গেছিল। তাই আমি মনের মতো কইরা এগুলা বানাইতে পারছিলাম স্যার।
বিব্রত তুহিন বলল, কী বলছেন এসব? আমি তো আপনাকে চিনি না! কবে ছবি দিলাম আপনাকে! কার ছবি দিলাম! আশ্চর্য ব্যাপার! আপনি কোথাকার কোন হরিদাস পাল!
হরিদাস পাল এবার অট্টহাসি দিল। ঝুলে পড়া চাদরটা কাঁধে তুলে বলল, না চেনারই কথা ভাইজান। আমার দাদা কইতেন, ভরা নদী পারানোর পর মাইনষে নৌকারে অনাদর করে। আপনে যদি আমারে চিনতেন, তাইলে এই মিথ্যাচার করতেন না। ভেবেছেন আপনার কটা টাকা পাইয়া আমি কাজটা করছি, তাই না? না ভাইজান, একদম না। টাকার জন্য আমি কাজটা করি নাই। টাকা আপনার কাছে আমি চাইও নাই। আপনি যখন আমারে পাঁচ শহীদের ছবিগুলান দিয়া কইলেন তাদের মূর্তিগুলো গইড়া দিতে, আমি কিন্তু একবারও জিগাই নাই আমারে কত দেবেন। ভালোবাইসাই কাজটা করছি। ভাবছিলাম আমার নাম হবে, লোকে আমার সুনাম করবে; কিন্তু পেপারে ছাপা হইলো আপনের নাম। ছাপা হলো আপনে এসব ভাস্কর্যের কারিগর। সবাই আপনের সুনাম করছে। সেই খবর আমারে পড়ে শোনাইল রোয়াইল স্কুলের হেড মাস্টার। একই গ্রামের ছেলে আপনি, আপনের প্রতি আমার খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল ভাইজান; কিন্তু খবরটা শুনে সব শেষ হইয়া গেল। আমার মনে হইলো এর প্রতিবাদ করা দরকার। তাই ছুইটা আইলাম। কাল থেকে খাওন-দাওন কিছু পেটে পড়ে নাই।
প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী তাকালেন তুহিন মাহমুদের চোখের দিকে। সেই চোখে আলো-ছায়ার লুকোচুরি। ঠিক ছায়া নয়, বলা যেতে পারে আলো-আঁধারির লুকোচুরি। আলো একবার আঁধারটুকু হটিয়ে দিতে চাইছে, আঁধার একবার আলোটুকু হটিয়ে দিতে চাইছে। ঢোক গিলল তুহিন। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল প্রধানমন্ত্রীর হাসি। তার দৃষ্টি ফিরল হরিদাসের মুখের দিকে। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর সংস্কৃতিমন্ত্রীর উদ্দেশে বললেন, আমি জানি না অভিযোগ সত্যি কিনা; কিন্তু অভিযোগটা গুরুতর। উড়িয়ে দেয়া উচিত হবে না। আপনি তদন্ত করে দেখুন। অভিযোগ সত্যি হলে দোষী যে-ই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। আপনি আমাকে আপডেট জানাবেন।
জি আচ্ছা। মাথা নাড়ালেন মন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর সংস্কৃতি সচিবকে ঘটনা দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিলেন মন্ত্রী। সচিব পরদিনই মাতৃভাষা কেন্দ্রের সচিবকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দিলেন এবং রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দিলেন দশ দিনের মধ্যে।
তদন্তের দিন ধার্য করল কমিটি। ডাকা হলো তুহিন মাহমুদ ও হরিদাস পালকে। তখন সকাল দশটা। কেন্দ্রের স্টাফদের অনেকেই এসে গেছে, বাকিরা আসার পথে। তুহিন তার বাইকটা মাঠের কোণায় রেখে অফিসে ঢুকতেই সদ্য উদ্বোধিত ভাস্কর্যগুলোর সামনে দেখতে পেল হরিদাসকে। চাদরমুড়ি দিয়ে টেরাকোটার নকশায় হাত বুলাচ্ছিল হরিদাস। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। তুহিনকে দেখে স্মিত হাসল। তুহিন গেল ক্ষেপে, তুমি কোথাকার কোন হরিদাস আমি দেখব। আমার এত বড় অপমান! তাও কিনা প্রাইম মিনিস্টারের সামনে! সাংবাদিকেরা আমরা পেছনে লেগেছে, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, মানুষ আমাকে সন্দেহ করছে, কোথাও আমি মুখ দেখাতে পারছি না। কী ভেবেছ তুমি, অ্যাঁ? আমাকে হাদারাম ভেবেছ? আমি চারুকলার স্টুডেন্ট, তোমার মতো কাঠমূর্খ না। অভিযোগ তোমাকে প্রমাণ করতেই হবে। নইলে আমি তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। পাঁচ কোটি টাকার কেইস। আমি দেখব এই দেশে তুমি থাকো কেমন করে।
হরিদাস স্থির, শান্ত। মুখে সেই মুচকি হাসি। হাসিটাকে প্রশস্ত করে সে বলল, যদি প্রমাণ করতে পারি এসব মূর্তি আমার গড়া, তাইলে কি আমি আপনের বিরুদ্ধে মামলা করব?
প্রমাণ না, তুমি আমার বাল করবা। আমি দেখব তুমি আমার কটা বাল ছিঁড়তে পারো। ফালতু লোক কোথাকার!
হা হা হা। রেগে গেলেন। শোনেন ভাইজান, আপনারে একটা কথা কই, শোনেন। আমি মূখ্খু মানুষ, কথাটা আমার মুখে বেমানান। তবে কথাটা আমার না, আমার দাদার। তিনি অল্প পড়ালেখা জানতেন। কিছুটা শাস্ত্রজ্ঞান ছিল। তিনি বলতেন, ক্রোধ হচ্ছে অক্ষমের অস্ত্র। ছোট ছিলাম তো, তাই তখন কথাটার অর্থ বুঝতাম না। এখন বুঝি। দাদা আরও একটা কথা বলতেন, যে বাড়ির খুঁটি দুর্বল সেই বাড়ি অল্প বাতাসেই কাঁপে, যেমন আপনি কাঁপছেন।
চুপ মালাউন কোথাকার!
মুহূর্তে হরিদাসের মুখটা শুকিয়ে গেল। মিলিয়ে গেল হাসিটাও। মলিন মুখে বলল, জন্মের পর এমন গালি মেলা শুনছি ভাইজান। নতুন কিছু না। তবে আপনে শিক্ষিত মানুষ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন, আপনের কাছ থেকে এমন গালি আশা করি নাই। যাকগা, দিয়াই যখন দিছেন, হজম কইরা নিলাম।
বেলা এগারোটায় শুরু হলো তদন্ত কমিটির সভা। অফিস সহকারী সবাইকে চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপটা একপাশে সরিয়ে কমিটির প্রধান বললেন, দেখুন হরিবাবু, আপনি যে অভিযোগটি করেছেন, তা অত্যন্ত গুরুতর। খোদ প্রাইম মিনিস্টার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। আশা করছি আপনি সত্য কথাটি বলবেন।
কাঠগড়ার আসামির মতো হরিদাস হাতজোড় করে বলল, মিছা আমি কমু না স্যার। ভগবানকে সাক্ষী রেখে কথা দিলাম, এক শব্দও মিছা কমু না।
প্রধান বললেন, এসব ভাস্কর্য যে আপনার তৈরি তার প্রমাণ কী?
প্রমাণ আমার দাবি, প্রমাণ আমার মুখের কথা। আগেই কইছি স্যার, আমি কোনো মিছা কমু না। আমি হরিদাস পাল সজ্ঞানে বলতেছি, ভাষা শহীদ রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার ও শফিউরের এসব মূর্তি আমার হাতে গড়া।
কমিটির এক সদস্য, একই সঙ্গে যিনি কেন্দ্রের সিনিয়র পরিচালক, কিছুটা চড়া গলায় বললেন, এটা কি কোনো প্রমাণ হলো? একই প্রশ্ন তুহিন সাহেবকে করলে তিনিও তো বলবেন ভাস্কর্যগুলো তার হাতে গড়া। এতে তো কিছু প্রমাণিত হয় না। আপনি প্রমাণ দাখিল করুন।
হরিদাস দাঁড়িয়ে গেল। আগের মতো হাতজোড় করে বলল, প্রমাণ আমার পরিবার। আমার বউ সাক্ষী, দুই মাইয়া সাক্ষী, এক পোলা সাক্ষী, আর সাক্ষী আমার পাড়াপড়শি। তারা দেখছে আমি কত যত্ন কইরা এই কাজ করছি। তারা অবশ্যই আমার পক্ষে সাক্ষী দিবো।
তুহিন ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল হরিদাসের দিকে। চড়া গলায় বলল, সাক্ষী আমারও আছে। আমার বউ সাক্ষী, ছেলে সাক্ষী, ভাই সাক্ষী এবং আমার পাঁচ বন্ধু সাক্ষী। অফিসের অন্তত দশজন কলিগও আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তারা দেখেছে আমি কীভাবে রাত-দিন পরিশ্রম করে এসব ভাস্কর্য তৈরি করেছি।
একটু নরম হয়ে গেল হরিদাস। তিরতির করে কাঁপতে লাগল ঠোঁট। চেয়ারে বসে একটু দম নিল। তারপর তুহিনের চোখে চোখ রেখে বলল, বাবু, আপনে আমার চোখে চোখ আর আপনের বুকে হাত রাইখা কন তো মূর্তিগুলা কার তৈরি? পারবেন? বুকে হাত দিয়া বলতে পারবেন?
ক্ষিপ্ত তুহিন বুকে হাত এবং হরিদাসের চোখে চোখ রখে বলল, খোদার কসম খেয়ে বলছি এসব ভাস্কর্য আমার তৈরি। যদি আমি এক বিন্দু মিথ্যা বলি, তবে আমার জিহ্বা খসে যাক। আল্লাহ আমাকে হালাক ও বরবাদ করে দিক।
কমিটি বুঝে গেল যে এভাবে হবে না। এভাবে উদঘাটন করা যাবে না সত্য। আরও অধিকতর তদন্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিল সরেজমিন গিয়ে তদন্ত করার। সরেজমিন গিয়ে সাক্ষ-প্রমাণ নিলে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে আসল সত্য।
কমিটির সদস্যরা পরদিন সকাল সকাল পৌঁছে গেলেন হরিদাসের বাড়িতে। হরিদাস তখন বাড়ির উঠোনে রোদ পোহাচ্ছিল। ঘর থেকে চেয়ার আর মোড়া এনে বসতে দিল সবাইকে। দেরি না করে কমিটি শুরু করল তদন্ত। হরিদাসের বউয়ের সঙ্গে কথা বলল, ছেলে আর মেয়েদের সঙ্গে কথা বলল। সবাই সাক্ষী দিল, হ্যাঁ, তারা দেখেছে হরিদাসই গড়েছে এসব ভাস্কর্য। কমিটি কথা বলল পাড়াপড়শিদের সঙ্গে। তারা বলল, হরিদাস তো সারা বছরই মূর্তি বানায়। নানা দেব-দেবীর মূর্তি। কখন কার মূর্তি বানায় তারা ঠিক জানে না।
তারপর কমিটি গেল তুহিনের গণকটুলির বাসায়। তার চাকরিজীবী স্ত্রীর সাক্ষ্য নিল, ছয় বছর বয়সী ছেলের সাক্ষ্য নিল, তার পাঁচ বন্ধুর সাক্ষ্যও নিল। তারপর অফিসে ফিরে সাক্ষ্য নিল তার কলিগদের। সবারই এক কথা, এসব ভাস্কর্য যে তুহিনের তৈরি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা নিজ চোখে দেখেছে তার অকাতর পরিশ্রম। নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তার যশ-খ্যাতি সহ্য করতে পারছে না বলে ঈর্ষাকাতর কিছু লোক এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। কোথাকার কোন হরিদাসকে দিয়ে তুহিনকে তারা হেনস্তা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তুহিন হাজির করল বিস্তর তথ্য-প্রমাণ। কোন দোকান থেকে পিতল কিনেছে, কোন দোকান থেকে রঙ কিনেছে, কোন দোকান থেকে হাতুড়ি-বাটাল আর শিরিষ পেপার কিনেছে- কেনাকাটার সব মেমো হাজির করল। আরো হাজির করল দুটি ভিডিও ক্লিপ, যার একটিতে দেখা গেল ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে সে নির্মিতব্য একটি ভাস্কর্যে টুক টুক করে বাড়ি মেরে আদল গড়ছে এবং আরেকটিতে দেখা গেল শহীদ বরকতের ভাস্কর্যে রঙতুলির কাজ করছে।
সব সাক্ষ্য-প্রমাণই তার পক্ষে গেল। সব দিক থেকেই তার পাল্লা ভারী হলো। অধিকতর তদন্তে কমিটি প্রায় নিশ্চিত হলো এসব ভাস্কর্য যে তারই গড়া। কিন্তু হরিদাস কেন এই উদ্ভট অভিযোগ করল? লোকটা কি মানসিক ভারসাম্যহীন? কথাবার্তায় তো তা মনে হয়নি। তবে কি তুহিনের সঙ্গে কেনো পূর্বশত্রুতা আছে? থাকতেও পারে। একই গ্রামে বাড়ি। জায়গাজমি নিয়ে ঝামেলা থাকাটা অসম্ভব নয়। নইলে একজন শিল্পীর বিরুদ্ধে সে এমন অভিযোগ তুলবে কেন?
নির্ধারিত দিনের আগেই তদন্ত প্রতিবেদন রেডি করে ফেলল কমিটি : মাতৃভাষা কেন্দ্রের সুযোগ্য কর্মকর্তা এবং সুপরিচিত শিল্পী তুহিন মাহমুদের বিরুদ্ধে রোয়াইল নিবাসী কুমোর হরিদাস পালের আনীত অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। তদন্তে শিল্পী তুহিন মাহমুদ সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সদ্য উদ্বোধিত পাঁচ ভাষা শহীদের দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্যগুলো যে তার তৈরি, তার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ধারণা করা হচ্ছে, কোনো পূর্বশত্রুতা উদ্ধার করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হরিদাস পাল শিল্পী তুহিন মাহমুদের বিরুদ্ধে এই অলীক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এতে সুনামহনি হয়েছে একজন গুণী শিল্পীর। এই তদন্ত কমিটি হরিদাস পালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করছে।
রিপোর্টটা যেদিন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে তার আগের দিন জরুরি ভিত্তিতে সদস্যদের তলব করলেন তদন্ত কমিটির প্রধান। ডাকলেন হরিদাস পাল ও তুহিন মাহমুদকেও। বেলা এগারোটার মধ্যেই সবাই হাজির হলো। সবাইকে নিয়ে তিনি গেলেন ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ভাস্কর্যের সামনে। সেখানে কিছু ককশিট আর স্তূপাকৃত কাদামাটি। হরিদাস ও তুহিনকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে প্রধান বললেন, এই ককশিট আর কাদামাটি দিয়ে আপনাদের বানাতে হবে শহীদ বরকতের ভাস্কর্য। হুবহু হতে হবে। কোনো খুঁত থাকা চলবে না। তবে একসঙ্গে নয়, বানাতে হবে আলাদাভাবে। আগে কে বানাবেন আপনারা ঠিক করে নিন।
আগে আমি বানাতে চাই স্যার। হাত তুলে বলল হরিদাস।
আপনার কোনো আপত্তি আছে? তুহিনকে জিজ্ঞেস করলেন প্রধান।
জি না। বলল তুহিন।
তাহলে শুরু করে দিন হরিবাবু।
হরিদাস চট করে খুলে ফেলল গায়ের চাদর। চাদরটা পুকুরের ঘাটলায় রেখে শুরু করল ককশিট কাটা। কেটে চলে অবিশ্রান্ত হাতে। আদল তৈরি করে লাগাতে শুরু করে মাটির প্রলেপ। সবার দৃষ্টি তার হাতের দিকে। তার হাত কোনো ভুল করে না। তার শিল্পিত হাতে ক্রমে ফুটে উঠতে থাকে শহীদ বরকতের নাক, তারপর ঠোঁট, তারপর চিবুক। ফুটে উঠতে থাকে চোখ, ভ্রু, কান, কপাল আর চুলের আকৃতি।
প্রধান তাকালেন তুহিনের মুখের দিকে। বললেন, তুহিন সাহেব, এবার আপনি শুরু করতে পারেন।
তুহিন নড়ে না। কিছু বলতে চেয়েও পারে না। তার চোখে চোখ রাখেন প্রধান। তার চোখে নেই আলো-আঁধারির সেই লুকোচুরি। আলো হটিয়ে দুই চোখ দখল করে নিয়েছে অন্ধকার। দৃষ্টি নামায় তুহিন। প্রধানের ঠোঁটে ফোটে স্মিত হাসি। পরাজিত পাকিস্তানি সৈনিকের নতমুখ ভাস্কর্যের মতো তুহিন দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক।
স্বকৃত নোমান: কথাশিল্পী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে