Views Bangladesh Logo

শুভ জন্মদিন ‘এশিয়ার কণ্ঠস্বর’ এস এম সুলতান

মাদের শিল্প সাহিত্য জগতের অনন্য নাম এস এম সুলতান। সুলতান ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। তার সম্পর্কে প্রচলিত রয়েছে, কখনো কখনো কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে যেতেন। বোহেমিয়ান। বন্য পশু ও বিরল প্রজাতির বিষধর সাপের সঙ্গে বসবাস করতেন নড়াইলে তার বাড়িতে। সেটি ছিল নড়াইল জমিদারদের ফেলে যাওয়া এক অন্ধকার পোড়োবাড়ি। চিত্রা নদীর পাড়ে ঝোপজঙ্গল আর শ্যাওলা বাড়িটিকে ঘিরে রাখত। আগে থেকেই বিষধর সাপ বসবাস করত।

তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে একসময় বসবাস শুরু করলেন। কিন্তু সাপসহ কোনো জীবজন্তুকে মারেননি। তারা ছিল পরিবারের সদস্য। সাপ গলায় পেঁচিয়ে চুমু খেতেন। দাঁড়কাক এসে তার হাতে বসে খাবার খেয়ে উড়ে চলে যেত গাছের ডালে। আবার ফিরে আসত। সংসারবিবাগী শিল্পরসিক এই মানুষের বাস জঙ্গলঘেঁষা এক পুরোনো দালানে। সঙ্গী হনুমান, বিড়াল, নেড়ি কুকুর, একপাল মুরগি। তথাকথিত মানুষের সঙ্গে নয়, প্রকৃতির সঙ্গেই যেন মিশে ছিলেন তিনি। এমনই প্রকৃতির একেবারেই কাছাকাছি ও শেকড়ের সঙ্গে মিশে, যিনি নিজেকে তৈরি করেছেন জাতশিল্পী হিসেবে।

মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে তার বর্ণিল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন বরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতান। কৃষকের বিপুল শক্তিকে যিনি মহাকালের আর্কাইভে রেখে গেলেন এবং দেখিয়ে গেলেন দরিদ্র কৃষক দুর্বল নয়। সেই বৈষম্যবিরোধী সাম্য ও সুন্দরের স্বমিশ্রিত শিল্পভাষার মহান চিত্রশিল্পী সুলতানের আজ ১০১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট এই দিনে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

আরেক কিংবদন্তিতুল্য, যিনি সুলতানতে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, মিশেছেন, ফ্রেমবন্দি করেছেন ক্যামেরার জাদুঘর খ্যাত নাসির আলী মামুন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পশ্চিমের শিল্পীরা বিশেষ করে ইউরোপে, ইতালিতে রেনেসাঁর শিল্পীরা আঁকত গড, গডেস, গির্জার ছবি কিন্তু সুলতান আঁকল- মাটির সঙ্গে যাদের গভীর সম্পর্ক, সেসব মানুষের, কৃষক, কৃষিসভ্যতা- যারা সমবায়ভিত্তিক কৃষিসভ্যতা শুরু করেছিল এই অঞ্চলে হাজার বছর ধরে। ঝিলাম নদী, সিন্ধু নদ- এসব অববাহিকায় যে মানুষ, সুলতানের ক্যানভাসে আসতে শুরু করে।

শিল্পীর পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। যদিও শৈশবে তার বাবা নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি; কিন্তু সুলতানের কাছে তার বাবা ছিলেন একজন শিল্পী। তৎকালীন জমিদার বাড়ির অনেক নকশা সুলতানের বাবার করা। সুলতান সেসব কাজ দেখেছেন একদম কাছ থেকে, যা তাকে পরবর্তীকালে শিল্পী হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

স্কুলে ভর্তি হলেও স্কুলের বাঁধাধরা নিয়মে পড়ালেখা তার ভালো লাগত না। সময় কাটত প্রকৃতিকে অনুভব করে। কখনো ক্লাসে বসে আবার কখনো চিত্রা নদীর পাড়ে বসে স্কেচ করতেন। স্কুলের শিক্ষক রঙ্গলাল ব্যাপারটি খেয়াল করলেন। সুলতানের খাতা দেখে বুঝতে পারলেন তার মধ্যে এক শিল্পী বাস করছে। তিনি সুলতানের ভেতরের সেই সত্তাকে গড়ে তুলতে চাইলেন। তিনি সুলতানকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে রঙ্গলাল সুলতানকে তার সব জ্ঞান উজাড় করে দিলেন। সেই শুরু।

১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভাদর দালি, পল ক্লি, মানেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীর ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।

তার জীবদ্দশায়ই তাকে নিয়ে উপন্যাস রচিত হয়েছে, স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হয়েছে, বই বেরিয়েছে, তিনি হয়ে উঠেছেন এক কিংবদন্তি। সুলতানের সৃষ্টির বলিষ্ঠ আহ্বান দেশ ও কালের ব্যবধান অনায়াসেই ছড়িয়ে গিয়ে একটি সর্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে। নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘আদম সুরত’ প্রামাণ্যচিত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি শামসুর রাহমান ‘সুলতান তার সালতানাত ত্যাগ করেননি’ প্রবন্ধে যে বাড়ির পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, ‘সুলতানের সেই লতাগুল্ম এবং গাছপালা ভরা, কালের ক্ষতচিহ্ন বহনকারী বাড়ি অনেকের স্মৃতিতেই ভাস্বর হয়ে আছে। আমরা যারা যাইনি নানা পন্থায় সেই ভবনে, তাদেরও কল্পনায় জাগ্রত তার পরিবেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকোষ্ঠ।’

জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক সুলতান সম্পর্কে বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমতাই সুলতানের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য...সুলতান বাংলা এবং বাঙালি বিষয়বস্তু নিয়ে যে সকল ছবি এঁকেছেন, সেগুলো দেশকালের গণ্ডি অতিক্রম করে সব মানুষের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে।’

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী একটি নিবন্ধে সুলতানের আঁকা ছবির অভাবনীয় বৈচিত্র্যের উল্লেখ করে ঢাকায় গ্যেটে ইনস্টিটিউটের এককালীন পরিচালক পিটার জেভিটসের সুলতান সম্পর্কে বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেন, ‘এই উপমহাদেশের গুটি কয়েক অসামান্য শিল্পীর মধ্যে সবচেয়ে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর।’ বস্তুত তার সৃষ্টিতে আমরা দেখি ঔপনিবেশিকতা-উত্তর এশিয়ার, না, সারা পৃথিবীর প্রত্যয়ী ও সংগ্রামী মানুষ। এমনকি আমরা দেখি বৈচিত্র্যময় নিসর্গের অনুভূতির বিস্ফোরণ।

অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তার ‘দেশজ আধুনিকতা, সুলতানের কাজ’ বইতে লিখেছেন,‘সুলতান তাহলে কী? একজন লুকানো পিকাসো? একজন গোপন ভিনসেন্ট ভান গখ? সুলতান দুই-ই। খুব সম্ভব, আরও।’ আমার কাছে মনে হয় এই ‘আরও’ হচ্ছে চিত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সঙ্গে সুলতানের গভীর ও নিবিড় মমত্ববোধ, একাত্মতা, যা তার সৃষ্টিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে। তদুপরি, তার ছবিগুলোয় প্রায়ই একটি বাণী রয়েছে, যার জন্যে পিটার জেভিট্স্ তাকে ‘এশিয়ার কণ্ঠ’ বলে অভিহিত করেছেন। ছবিতে সংগ্রামী, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের মর্মবেদনা নিয়েছে এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়ী আশাবাদী রূপ।

গণবুদ্ধিজীবী লেখক আহমদ ছফা, যিনি সুলতানের গভীরে গিয়ে তার অনুভূত উপলব্ধির অতুলনীয় অভিব্যক্তি দিয়েছেন, বলেন, ‘সুলতানের কৃষকরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তার মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশির শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তান-বতী হতে বাধ্য করে।’ কাশ্মীরের অপরূপ নৈসর্গিক বৈচিত্র্যের পটভূমের মুষ্টিবদ্ধ বলিষ্ঠ হাত যেন রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে উন্মুখ।

আহমদ ছফা বলেন, ‘এখানেই সুলতানের অনন্যতা। এখানেই বাংলার কোনো শিল্পীর সঙ্গে, ভারতবর্ষের কোনো শিল্পীর সঙ্গে, সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নন্দলাল, জয়নুল আবেদিন, আবদুর রহমান চুঘতাই, নাগী, ওই সকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে। হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পাদর্শের যে ব্যাপক সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি- একজন সুলতান ছাড়া।’

প্রথিতযশা শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদ, যিনি সুলতানকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তার ‘আমার স্মৃতিতে সুলতান’ নিবন্ধে বর্ণনা করেছেন, কবিতা আবৃত্তি ও দর্শন আলোচনা সুলতানের সৃষ্টিধর্মী চিন্তাপ্রবাহে কী গভীর রেখাপাত করত। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন আমার রবীন্দ্রনাথের ‘পৃথিবী’ কবিতার আবৃত্তি শুনে তিনি (সুলতান) চটপট এক ছবি এঁকে বসলেন। পঙক্তিগুলো ছিল এই: বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎ চঞ্চু বিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল, কালো শ্যেন পাখির মতো তোমার ঝড়...।’

এশিয়ার কণ্ঠস্বর, কিংবদন্তি এস এম সুলতানের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ