যুদ্ধবিরতিতে রাজি হামাস, গাজা সিটি দখলে এগোচ্ছে ইসরায়েল
২২ মাস ধরে চলমান যুদ্ধ বন্ধে ৬০ দিনের নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তবে এতে সাড়া না দিয়ে গাজা উপত্যকা দখলে নেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রিজার্ভ সৈন্যদের মোতায়েনের পাশাপাশি নিয়মিত সৈন্য বাড়াতে যাচ্ছে ইসরায়েল।
তবে ১১ আগস্ট থেকে চলমান বিস্তৃত অভিযানের অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী টানা দশম দিনের মতো গাজা সিটির দক্ষিণ-পূর্বে জায়তুন ও সাবরাপাড়ায় বিমান ও কামান হামলা জোরদার এবং বাড়ি-ঘর ধ্বংস, গুলি চালানো, ড্রোন-বিমান থেকে বোমা ডিভাইস ব্যবহার ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি অব্যাহত রেখেছে। গাজাজুড়ে ফিলিস্তিনিদের হতাহত করাসহ জোরপূর্বক অনাহারে রেখে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া, এমনকি খাদ্য দিতে নিজেদের ত্রাণকেন্দ্রের সামনে ডেকে এনে গুলি করে হত্যাও করা হচ্ছে।
হামাস জানায়, তারা ও অন্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো কাতার ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সরকার এ বার্তা পেয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল ও চ্যানেল ১২।
বুধবার (২০ আগস্ট) কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, সর্বশেষ ওই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ৬০ দিনের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এ সময়ে ইসরায়েলি সেনারা অন্যত্র সরে যাবেন, যেন গাজায় মানবিক সহায়তা ঢুকতে পারে। প্রস্তাব অনুসারে, ওই সময়ের মধ্যে ৫০ ইসরায়েলি জিম্মির অর্ধেককে ছেড়ে দেয়া হবে। বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের।
অন্যদিকে ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো জানায়, গাজা সিটিতে যুদ্ধ করতে প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আরও ৬০ হাজার রিজার্ভ সৈন্যকে ডাকবে। উপত্যকায় যুদ্ধরত নিয়মিত সৈন্যও বাড়ানো হবে। সৈন্যদের একত্রিত করা ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে বলে জানিয়েছে দৈনিক ইয়েদিওথ আহরোনোথ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও জানায়, আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ‘কয়েক মাস ধরে চলা দীর্ঘস্থায়ী অভিযানের’প্রস্তুতিতে সেনাবাহিনীর রিজার্ভ সৈন্যের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারে উন্নীত হবে। সেনাবাহিনীর জরুরি খসড়া আদেশ অর্ডার ৮ও এরই মধ্যে জারির কথা জানায় চ্যানেল ১২। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা অনুমোদনের পর আইডিএফ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানায় ইসরায়েলি পাবলিক ব্রডকাস্টার কেএএন।
৮ আগস্ট ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গাজা উপত্যকা ধীরে ধীরে ফের দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন করে, যার শুরু হয়েছে গাজা সিটি থেকে।
এদিকে গাজা সিটি সম্পূর্ণ দখলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বুধবার রাত পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও অন্তত ১৮৫ জনকে আহত করেছে আইডিএফ। এছাড়া আগের ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসস্তূপ থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া অনাহার ও অপুষ্টিতে মারা গেছেন আরও তিনজন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু যুদ্ধে গত ২২ মাসে প্রাণহানি দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ১২২ জনে, আহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ৫৬ হাজার ৭৫৮ জন। অন্যদিকে দুর্ভিক্ষপীড়িত ছিটমহলটিতে অনাহারজনিত মৃত্যু ঘটেছে ২৬৯ জনের, যাদের ১১২ জনই শিশু।
আল জাজিরা জানায়, নিহতদের ২২ জন গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রে মানবিক সহায়তা সংগ্রহে গিয়ে মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৫০ জন। এ নিয়ে গত ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত সাহায্য নেয়ার সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৮ জনে এবং আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ৯৪৭ জনেরও বেশি।
উত্তর গাজার জাবালিয়ার আল-আওদা হাসপাতালের সূত্র জানায়, মধ্য গাজার উত্তর নুসাইরাতের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে আটজন ত্রাণপ্রার্থী নিহত হন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের অন্য কেন্দ্রে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিস্তিনের জাতীয় দলের প্রাক্তন বাস্কেটবল খেলোয়াড় ৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ শালানও। কিডনি বিকল হয়ে পড়া মেয়ে মরিয়মকে সাহায্য করতে খাবার ও ওষুধ সংগ্রহে মরিয়া চেষ্টার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
ফিলিস্তিনের সরকারি সংবাদ সংস্থা ওয়াফার বরাতে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু জানায়, ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে উত্তর গাজার জাবালিয়া আল-নাজলা শহরের একটি বাড়িতে তিনজন নিহত ও ১০ জন আহত এবং দক্ষিণ সাবরাপাড়ার অন্য একটি বাড়িতে দুজন শিশু নিহত ও আরও কয়েকজন আহত হন।
বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় দেয়া শরণার্থী শিবিরগুলোতে হামলায় গাজা সিটির পশ্চিমে শাতিরের একটি তাঁবুতে একই পরিবারের পাঁচজন, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি তাঁবুতে শিশুসহ চারজন, জায়তুনপাড়ায় একই পরিবারের আরও চারজন, খান ইউনিসের কয়েকটি তাঁবুতে একজন নারী ও তার দুই শিশু সন্তানসহ আটজন, দক্ষিণ গাজার একটি তাঁবুতে তিনজন এবং দেইর এল-বালাহে একটি তাঁবুতে চারজন নিহত হন। খান ইউনিসের আল-মাওয়াসিতে অন্য তাঁবুতে ১২ জনসহ এসব হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৩৫ জন।
গাজার সিভিল ডিফেন্স জানায়, তাদের কর্মীরা উত্তর গাজার সমুদ্র তীরের একটি তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত পাঁচজনের মরদেহ ও আহত তিনজনকে উদ্ধার করেছে। দক্ষিণ গাজা শহরের ঘর-বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়াসহ পূর্ব গাজা শহরের তুফাহ এলাকায় ব্যাপক গোলাগুলিরও খবর পাওয়া গেছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে