আধা খাওয়া আপেল, বিশ্বযুদ্ধ ও অ্যালান টুরিং
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে...’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার মতো যুক্তরাজ্যের সরকার যেদিন তার ভুল স্বীকার করে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এর সাড়ে পাঁচ দশক আগে নিজের জীবনের ইতি টেনেছেন আধুনিক কম্পিউটারের তাত্ত্বিক প্রবক্তা অ্যালান টুরিং। সালটা ২০০৯। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বলেন, ১৯৫০-এর দশকে ভুল করেছিল যুক্তরাজ্য সরকার। ভুল ছিল যুক্তরাজ্যের বিচার ও আইন ব্যবস্থায়। তাই আমাদের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাধর মানুষটাকে ভুল বিচারে ভুল দণ্ড দেওয়া হয়। এ জন্য যুক্তরাজ্য সরকার লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
কিন্তু এতদিন পরে আর ভুল স্বীকার করে কী হবে। যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষ জীবদ্দশায় প্রতিভাধর লোকটার কৃতিত্বের খবর জানতেই পারেনি। উল্টো ‘ভুল’ বিচারে গোটা জাতির কাছেই ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। অথচ সেই মানুষটার কারণেই কিনা ব্রিটেন মহাপ্রতাপশালী হিটলারের জার্মান বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল। এতটা অবিচার কি পাওনা ছিল লোকটার? যে অপরাধে তাকা সাজা দেওয়া হয়, সেই অপরাধ যদি যুদ্ধের সময় হতো, যখন তিনি নাৎসি বাহিনীর একের পর এক গোপন মিশনের গুপ্ত সংকেত ফাঁস করছেন- তখন যদি প্রমাণিত হতো তার অপরাধ- তখন কি ব্রিটিশ সরকার পারত তাদের তুরুপের আসল তাসকেই এভাবে শাস্তি দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে?
সম্ভবত পারত না। কারণ এরই নাম রাজনীতি। রাজনীতির ময়দানে কঠিন সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৈনিকের গুরু পাপও লঘু করে দেখা হয়। কিন্তু প্রয়োজন ফুরালে লঘু ব্যাপারটাকেও গুরু করে দেখানোর প্রবণতা সব যুগের সব ক্ষমতাবানদের মধ্যে ছিল, এখনো আছে। ২৩ জুন ১৯১২। লন্ডনের জন্ম নেয় এক শিশু। শিশুটির বাবা জুলিয়াস টুরিং। ভারতে কর্মরত আইসিএস অফিসার। মা ইথেল সারা স্টোনির জন্মই ভারতের মাদ্রাজে। জাতে ব্রিটিশ হলেও কাজের খাতিরে তাদের থাকতে হয় উপমহাদেশে। লম্বা ছুটিতে লন্ডনে যান বছরে এক কি দুবার। তেমনই এক ছুটির মৌসুমে লন্ডনেই জন্ম হয় অ্যালান টুরিংয়ের। কিছুদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে ভারতেই কাটান। একেবারে জীবনের প্রথম বছরটাতে। তারপর মাত্র ১৫ মাস বয়সেই লন্ডনে বসবাস শুরু করতে হয় মা-বাবাকে ছেড়ে, সেখানকার এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল পরিবারে।
ভারত তখনো দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এখানে না আছে ভালো স্কুল, না আছে ভালো স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া সংক্রামক রোগে শিশুদের মৃত্যুও নিত্য ঘটনা এখানে। এহেন একটা দেশে একজন সামর্থ্যবান বাবা হিসেবে জুলিয়াস তার দুই ছেলেকে নিজেদের কাছে রাখা যৌক্তিক মনে করেননি। তাই ওই কর্নেল পরিবারে রেখে ছেলেকে ভালো স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। লম্বা ছুটি পেলে বাবা-মা যান ছেলেদের দেখতে। ছেলেরা এরপর স্কুলে যেতে শুরু করে। কর্নেলের বাড়ি ছেড়ে ঠাঁই হয় স্কুলের বোর্ডিংয়ে। বড় ভাই জনের সঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকা অ্যালান ভীষণ মিস করে তাদের। এই ব্যাপারটাই তাকে অন্যরকম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলো।
বর্তমান বাংলাদেশই হোক আর সেকালের ব্রিটেন- সব স্কুলেই কিছু মারদাঙ্গা টাইপের ছেলে থাকে। এদের কাজই অন্যের পেছনে লাগা। এমন কিছু ছেলে ছিল অ্যালানের স্কুলের বোর্ডিংয়ে; কিন্তু সঙ্গে বড় ভাই জন টুরিংয়ের মতো শক্তপোক্ত ছেলে ছিল বলে, দুষ্টুর দল অ্যালানকে ঘাটাতে সাহস পেত না; কিন্তু জন তো বড়। স্কুলেও ভর্তি হয়েছে আগে। তাই ওই স্কুল ছেড়ে অন্য একটা উচ্চতর স্কুলে চলে যেতে হয় জনকে। শান্তু-শিষ্ট অ্যালানের ওপর নেমে আসে র্যাগিংয়ের খড়গ।
এমনিতেই অ্যালান চুপচাপ ছেলে। র্যাগিংয়ের খপ্পরে পড়ে আরও একা হয়ে যায়। নিজের মধ্যেই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেখান থেকেই তার বদলে যাওয়ার শুরু কি না কে জানে। তবে সেই বোর্ডিংয়েই একদিন নিজের সম্পর্কে জানতে পারে এক মর্মান্তিক সত্য, যে সত্য তাকে ভভিষ্যতে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। হবে মৃত্যুর কারণ।
২৫ মে ২০১২। লন্ডনের পার্লামেন্টে বিশেষ ভাষণ দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার ভাষণে একসময় উঠে আসে ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা তিন ব্যক্তিত্বের নাম, যারা বিশ্ববিজ্ঞানকে নিজেদের অবদানে ঋব্ধ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম নামটা স্যার আইজ্যাক নিউটনের। তালিকায় দ্বিতীয় নামটা চার্লস ডারউইনের। তৃতীয় নামটাতেই ছিল চমক। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, আর্থার এডিংটন, জন ডাল্টন বা আরও বড় নাম যদি চান তাহলে মাইকেল ফ্যারাডে কিংবা জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েলের নাম এসে পড়লে খারাপ দেখাত না; কিন্তু এসব রথী-মহারথীদের টপকে ওবামার লিস্টে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নেন অ্যালেন টুরিং! কিন্তু কেন?
টুরিংয়ের কাজের মহিমা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ইউরোপের নেতাদের থরহরি কম্প উঠছে। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের নাৎসি পতাকা তখন পত পত করে উড়ছে ইউরোপের আকাশে। জার্মান বাহিনী শুরুটা করেছে পোলান্ডকে দিয়ে, তারপর একে একে ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, চেকোস্লোভাকিয়া হয়ে ফ্রান্সকে পর্যন্ত পর্যদুস্ত করে দখল করে নেয়। ইউরোপের অন্যতম বড় শক্তি ইতালি হিটলারের তখন সহযোগী। রাশিয়া একা কত লড়বে! যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত প্রযুক্তি আর আর রাশিয়ার সৈন্যরা ফ্রন্টলাইনেস লড়ছে ব্রিটিশদের মিত্রশক্তি হয়ে। কিন্তু হিটলারের বুদ্ধির কাছে ধরাশায়ী সবাই। আটলান্টিক মহাসাগরজুড়ে চলছে হিটলারের নৌবাহিনীর অতর্কিত হামলা। সাবমেরিনের সাহায্যে। সেই হামলায় তছনছ হচ্ছে ব্রিটেনের রণতরি, পণ্যবাহী জাহাজও। খাবার ও বাণিজ্যে ভয়াবহ সংকট। কিন্তু কিছুতেই জার্মান বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা আগেভাগে জানতে পারছে না ব্রিটিশরা। এমনকি রাডারও শনাক্ত করতে পারছে না জার্মান ডুবোজাহাজের গতিবিধি।
কীভাবে এত নিখুঁত আক্রমণের পরিকল্পনা তারা আটছে? কী তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র? মূলমন্ত্র বুঝতে অসুবিধা হয়নি ব্রিটিশ সেনা কর্তাদের। তাদের সাফল্যের রহস্য লুকিয়ে আছে গোপন সাংকেতিক বার্তায়। যে বার্তা পাঠানো হয় রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে; কিন্তু কী সেই বার্তা? কীভাবেই বা উদ্ধার হবে তার গোপন সংকেত। রেডিও বার্তার সংকেত শত্রুশিবিরও পায়; কিন্তু কিছু এলোমেলো বর্ণামালা আর কিছ হযবরল সংখ্যা ছাড়া সেগুলোর কোনো মানে নেই। অথচ যুদ্ধকালীন এমন গুপ্ত বার্তার প্রচলন দুহাজার বছর আগেই করেছিলেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। প্রথম দিকে সেগুলো ছিল খুব সরল। একটা অক্ষরের বদলে আরেকটা অক্ষর বসিয়ে লেখা হতো সাংকেতিক বা সাইফার কোড।
এই চিঠি যদি শত্রু শিবিরের হাতে পড়ে, প্যাটার্ন না জানলে অর্থ বের করা অসম্ভব। কিন্তু প্রাচীন যুগের সাইফার কোডগুলো দ্রুতই ভাঙতে সক্ষম হন বিশেষজ্ঞরা। তাই প্রায় ২ হাজার বছর পর অমন বার্তা পাঠালে কোনো লাভ হবে না। এমন বার্তা পাঠাতে হবে যেন ভাঙা সহজ না হয়। সে সময় একটা যন্ত্র যদি তৈরি হয়, যার সাহায্যে খুব জটিল কোড তৈরি সম্ভব। সেই যন্ত্রটার নাম এনিগমা মেশিন। আবিষ্কার ডাচ উদ্ভাবক হিউগো কখ। কিন্তু এই যন্ত্র কী কাজে লাগবে সেটা বুঝতে পারেননি কখ। বুঝেছিলেন একজন- জার্মান প্রকৌশলী আর্থার স্খারবিয়াস। তিনিই যন্ত্রটি কিনে নেন। প্রথম দিকে এটা ছিল একটা সরল টাইপরাইটারের মতো দেখতে; কিন্তু তার কাজকারবার দুর্বোধ্য। সেই যন্ত্রের লেখা কোড ভাঙা যে সহজ কাজ নয়, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী।
২১ অক্টোবর ১৯৪১। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলকে চিঠি লেখেন গভর্নমেন্ট কোড অ্যান্ড সাইফার (জিসি অ্যান্ড সি) স্কুলের চারজন সাধারণ অফিসার- অ্যালান টুরিং, গর্ডন ওয়েলস ম্যান, হিউ আলেক্সান্ডার ও স্টুয়ার্ট মিলনার। তাদের আর্জি পর্যাপ্ত লোকবলের সংকটে ভুগছে জিসি অ্যান্ড সি। অথচ এই সময় তাঁদের লোকবল বাড়ানো খুব জরুরি।
জিসি অ্যান্ড সির অফিস লন্ডন শহরে। সেখানকার কর্মচারীরা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে কোড উদ্ধারে। এটা এক ধরনের গোয়েন্দাগিরি। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই, ১৯১৯ সালে। তখনকার ব্রিটিশ সরকার বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে চাইলে প্রতিপক্ষের সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধার করা কতটা জরুরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেটা আর বড় ও কঠিন করে তুলেছিল এনিগমা মেশিন।
কিন্তু যত দুর্বোধ্যই হোক, অ্যালান টুরিং জানতেন পাঠোদ্ধারের অযোগ্য নয় কোনো সাংকেতিক বার্তাই। দরকার কেবল ইটের বদলে পাটকেল। এজন্য দরকার লোকবলের। এই লোকদের মধ্যে কেউ করবেন টাইপ রাইটিংয়ের কাজ, কেউ কেউ হয়তো ইঞ্জিনিয়ার, আরও দরকার একদল ভাষাবিজ্ঞানী আর একদল গণিতজ্ঞ। ভাষাবিজ্ঞানী দরকার- কারণ প্রাচীন শিলালিপির পাঠোদ্ধারে ভাষাবিজ্ঞানীরা দক্ষ। লিপির প্যাটার্ন দেখে তারাই প্রাচীন মিশরীয় ও ব্যবলনীয় শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন। সাইফার কোডের প্যাটার্ন বুঝতেও তাঁদের সাহায্য দরকার পড়তে পারে। ইঞ্জিনিয়ার দরকার কারণ- প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মেরামত, তৈরি এমনকি সাইফার কোড ভাঙতেও তারা হয়তো কাজে আসবেন।
গণিতজ্ঞ কেন?
এটা আসলে টুরিংয়ের ভাবনার ফসল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাইফার কোড তখন এত জটিল আকার ধারণ করেছেন, এর জন্য গণিতের সাহায্য লাগবে। গণিতের কাজ হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে জটিল প্যাটার্নের জন্য সূত্র তৈরি করা। টুরিংয়ের বিশ্বাস ছিল সাইফার কোডেরও হয়তো কোনো গাণিতকি ফরমুলা তৈরি করা সম্ভব, যার সাহায্যে অনেক বড় বড় কোডও ভেঙে সরল করে ফেলা সম্ভব। সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা টুরিংয়ের মাথায় খেলে, সেটা হলো একটা মেশিন তৈরি করা দরকার, যা গণিতবিদদের গণনার কাজ সহজ করে দেবে।
চার্চিলকে এ কারণেই টুরিং আর তার সহকর্মীরা চিঠি লিখেছিলেন। লোকবল দরকার- কিন্তু ওপরওয়ালাদের কাছে ধরনা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। তাই তারা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার এই আয়োজন করেন। চার্চিল টুরিংদের দাবি মঞ্জুর করেন। ওপওয়ালাদের নির্দেশ দেন জিসি অ্যান্ড সির চাহিদা যেন মেটানো হয়। ফলে এক লাফে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীসংখ্যা ২০০ থেকে বেড়ে দেড় হাজারে উন্নীত হয়। টুরিং তখন কোমোর বেঁধে কাজে লেগে পড়েন। সাইফার কোড ভাঙতে ব্যবহার করেন শতবছর আগের ব্রিটিশ গণিতবিদ টমাস বেয়েসের থিওরেম। সত্যি সত্যিই এই থিওরেম ব্যবহার করে তিনি জার্মানদেরে এনিগমা মেশিন থেকে তৈরি করা সাইফার বার্তার কোড উদ্ধারের পদ্ধতি আবিষ্কার করে। কোড উদ্ধার আরও সহজ করার জন্য এনিগমা মেশিনের পাল্টা একটা মেশিন তৈরি করেন তিনি। যার নাম বম্ব।
এরপর আর অতর্কিত বা ঝটিকা আক্রমণে নাকাল হতে হয়নি ব্রিটিশ সৈন্যদের। হিটলারের সাবমেরিন কখন কোথায় আঘাত হানবে, সাইফার বার্তা ডিকোড করেই তা জেনে ফেলছেন টুরিং। সেটা জানিয়ে দিচ্ছেন ব্রিটিশ বাহিনীকে। খেল খতম, আঘাত হানার আগেই হিটলারের সাবমেরিন ধ্বংস হচ্ছে ব্রিটিশ আক্রমণে। আটলান্টিকে একের পর এক ব্যর্থতা, গোপন বার্তা ফাঁস হচ্ছে, স্থল যুদ্ধেও দিশেহারা হিটলার বাহিনী। ব্রিটিশ আর রুশ সেনাদের আক্রমণে ছত্রখান তারা। ফল হিটলারের অভিসম্ভাবি পরাজয়। সেটা বুঝতে পেরেই এই নাৎসি নেতা নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। রুশ-ব্রিটিশ-মার্কিন বাহিনী দিয়ে গড়া মিত্রবাহিনী ইউরোপ থেকে পিছু হটায় নাৎসি বাহিনীকে। পরে জার্মানির ভেতরে ঢুকে তাদের শেষ ডেরাও জয় করে নেয়। আর এসব কিছুই হতো না, যদি না ট্যুরিং অসাধ্য সাধন করতেন। অথচ যুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটিশ বাহিনী তার রণকৌশল সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করেনি। তাই ব্রিটিশ আমজনতা জানতে পারেনি অ্যালান টুরিং নামের এক অসাধারণ গণিতবিদের হিসেবি মাথার মাহাত্ম্য।
শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না টুরিংয়ের মাহাত্ম্য। এর আগে ২২ বছর বয়সে যখন টুরিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন বিখ্যাত গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্টের একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। চ্যালেঞ্জটা ছিল এমন- এমন কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি কি আছে, যার সাহায্যে বলা যাবে গণিতের স্বীকার্যগুলো ঠিক না ভুল? এর সমাধান করতে গিয়েই একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করেন টুরিং। যেখানে একটা লম্বা ফিতায় সংখ্যা লেখা থাকবে। সেই সমস্যাগুলো স্ক্যান করে হিসাব কষে দেবে একটা যন্ত্র। সেই ফিতাটাই ছিল সেকালের প্রোগামিং টুল। সেই টুল কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে যন্ত্র তৈরি করলে সবচেয়ে ভালো আউটপুট পাওয়া যাবে, সেটারও একটা স্পষ্ট ধারণা দেন টুরিং। লেখেন ৩৫ পৃষ্ঠার একটা গবেষণা প্রবন্ধ। বলাই বাহুল্য, আজকে সারা দুনিয়ার কম্পিউটারের দাপট দেখাচ্ছে যে মাইক্রোসফট কোম্পানি, এর প্রাথমিক ভার্সনটা ছিল একটা কাগজের শিট ফুটো করে তৈরি একটা প্রোগ্রাম টুল। যার তাত্ত্বিক প্রবক্তা অ্যালান টুরিং।
স্কুলেই টুরিং বুঝতে পারেন, তিনি সমকামী। কিন্তু এর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তার আরেক সমকামী বন্ধুর সঙ্গে চলে তার গোপন প্রণয়। সেই বন্ধু মারা যায় কৈশোরেই, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে। সেটা টুরিংয়ের জন্য বড় আঘাত। এরপর বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ শেষে শান্তির সময় যখন এলো, হাতে অনেক অবসর। সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের জন্য একটা আধুনিক কম্পিউটার তৈরির কাজও করছেন। সেই সময় টুরিং তখন আরেকজন সেক্স পার্টনার খুঁজে নিয়েছেন। নাম তার আরনল্ড। তরতাজা যুকব। গোপনে টুরিংয়ে বাসায় চলে অভিসার। আরনল্ডের এক ছিঁচকে চোর বন্ধু ছিল। সে জানতে পারে টুরিংয়ের বাড়ি দামি দামি জিনিসে ভরা। সুতরাং ঝোপ বুঝে কোপ দেয়। টুরিংয়ের বাড়ি থেকে খোয়া যায় দামি দামি জিনিস। তিনি শরণাপন্ন হন পুলিশের।
টুরিং তো আর জানতেন না, এই কাজ তার পার্টনারের বন্ধুর। পুলিশ তদন্তে নামে। চোর ধরা পড়ে। কিন্তু মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে টুরিং আর আরনল্ডের গোপন অভিসারের কাহিনি। তখন ব্রিটেন তো বটেই গোটা বিশ্বেই সমকামিতা মস্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো।
আদালতে বিচার হয় টুরিংয়ের। বিচারক রায় দেন, বলেন দুটো অপশন খোলা এখন টুরিংয়ের সামনে। হয় জেলে যেত হবে, নয়তো চিকিৎসা কেন্দ্রে। টুরিং চিকিৎসা নিতে রাজি হন। সরকারি তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলে। তাকে দেওয়া হয়, এক ধরনের হরমোন ইনজেকশন। তাতে যৌন উত্তেজনা কমে বটে, কিন্তু লাগাতার হরমোন প্রবেশের ফলে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা। একসময় টুরিংয়ের বুকে তৈরি হয় নারীদের মতো স্তন। এই ব্যাপারটায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন টুরিং। ক্ষোভে-দুঃখে বিষ মাখানো আপেল খেয়ে করেন আত্মহত্যা। সেটা ১৯৫৪ সালের ৭ জুন। এ ঘটনার ৫৫ বছর পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ওই ভুল স্বীকার। ততোদিনে টুরিং ভুলত্রুটির অনেক ঊর্ধ্বে।
বিখ্যাত কম্পিউটার ও স্মার্টফোন কোম্পানি অ্যাপলের লোগোতে একটা আধা খাওয়া আপেল দেখা যায়। অনেকে মনে করেন, এই আপেল আসলে টুরিংয়ের সেই বিষাক্ত মৃত্যুফল। প্রতিটা লগোর একটা মিনিং থাকে। আধুনিক কম্পিউটারের তাত্ত্বিক ধারণা টুরিংয়ের মাথাতেই এসেছিল। অ্যাপল একটা কম্পিউটার কোম্পানি, তাই এর লোগোর মাধ্যমে যদি টুরিংকে সম্মান জানানো হয়, সেটা বরং অর্থবহ হয়। কিন্তু অ্যাপল কোম্পানি আর যিনি এই লগোর ডিজাইনার তিনি কখনো স্বীকার করেননি ব্যাপারটা। তাদের কথা, কম্পিউটারের বাইনারি একক বাইটের অর্থ বোঝাতেই এখানে কামড়ে খাওয়া আপেল ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু তাই যদি হয়, সেটা আপেল না হয়ে অন্য কোনো ফলও হতে পারত। কিন্তু কোম্পানির নাম যে আপেল, তাই লোগোতে আপেল রাখা হয়েছে। অ্যাপলের লোগোতে যাই থাক, একটা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য টুরিংকে কৃতিত্ব দিতেই হবে, যে কৃতিত্ব তিনি জীবদ্দশায় পাননি। তার দেশের জনগণও এই গৌরবের কথা তখন জানতে পারেননি তখন, কিন্তু এখন গোটা বিশ্ব জানে।
আবদুল গাফফার রনি: বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে