মুক্তিযোদ্ধা লিনু হকের স্মৃতিচারণা
গেরিলা কিশোরী, পাকিস্তানি শিশু, মাঝির স্ত্রী আর গুলিবিদ্ধ পাকিস্তানি নারী
দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি জনযুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়, সমরক্ষেত্রের বাইরেও যুদ্ধ বিস্তৃত হয়। দেশের ছোট-বড়, নারী-শিশু, চাকরিজীবী-গৃহস্ত প্রতিটি মানুষ একেকজন যোদ্ধা হয়ে উঠে। যুদ্ধের ভেতর এ আরেক যুদ্ধ, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের গল্পগুলো হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া এসব টুকরো গল্পগুলোকে জোড়া দেয়ার প্রয়াস এবার বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফেরদৌসী হক লিনুর স্মৃতি সংগ্রহ। বহুগল্পের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি ছোট গল্প।
বিচ্ছু গেরিলা কিশোরী
বাড়ির ছেলেরা, ভাইরা, পিতারা যখন যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে দেশের সীমান্ত পার করে ওপারে চলে গেছে, তখন বিভিন্ন বাড়ির তরুণ গৃহিণী আর কিশোরী মেয়েরা সময় পার করেছে উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে। একদিকে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে দেশ স্বাধীন হয়েছে এই সংবাদ শোনার ব্যাকুলতা। এসবের মধ্যে কিন্তু তারা বসে থাকেনি, তারা নিজেদের মতো করে যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এরকমই একটা প্রয়াস ছিল, সেসব আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারের কিশোরী মেয়েদের গেরিলা যুদ্ধ। এই গল্পে তারাই বিচ্ছু গেরিলা। সেই দলের অন্যতম সদস্য লিনু হক।
যুদ্ধের শুরুতেই যখন আজিমপুরের তরুণরা যুদ্ধে যাওয়া শুরু করল, তখন লিনু হক জেদ ধরলেন তিনিও যুদ্ধে যাবেন। তোরা ছোট, তোরা এখন বাড়িতেই থাক, প্রয়োজন হলে ডেকে নিব, এই বলে বড়রা যুদ্ধে চলে গেলেন। তাতে কিন্তু লিনু হক আর তার কিশোরী বন্ধুরা দমে যাননি। তারা সেই ছোট্ট কাঁধে তুলে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করার মতো বিশাল কাজ। সরকারি কলোনি হওয়াতে যুদ্ধের উত্তাল সময়ে আজিমপুরের বিচ্ছুরা অনেকটাই নিরাপদে ছিল। সেই নিরাপত্তার গণ্ডি পেরিয়ে কয়েকজন কিশোরী প্রতিদিন রাত ৩টায় বের হয়ে পড়ত। হাতে পাকিস্তান বিরোধী পোস্টার আর ঘরে তৈরি আঠা। আজিমপুর, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত পুরোটা এলাকার দেয়াল আর বিদ্যুতের খুঁটিতে সেঁটে দিত সেই পোস্টার। সেসময় পোস্টার বানানো মুখের কথা ছিল না। কাজ চলত কয়েক ধাপে। ঢাকার এই মাথা থেকে ঐমাথা কয়েকহাত ঘুরে কাজ শেষ হতো। ধানমণ্ডির কেউ হয়তো ভাষা ঠিক করে দিচ্ছেন, আরেক এলাকার আরেকজন ছবি এঁকে দিচ্ছেন, আবার আরেকজন সেটা গোপনে প্রেসে নিয়ে গিয়ে প্রিন্ট করে আনছেন। এসব ধরা পড়লে অকথ্য নির্যাতন বা নির্ঘাত মৃত্যু। সেই ঝুঁকি মাথায় নিয়ে চলত তাদের এই কার্যক্রম। এমনকি ঈদের দিনেও থেমে থাকত না তাদের এসব কাজ।
এই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ার মতো অবস্থাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। সরকারি কলোনি হওয়াতে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে বাস করত পাকিস্তান সমর্থক কর্মকর্তাদের পরিবার। তাদের কড়া নজর ছিল এসব বিচ্ছু মেয়েদের দলের উপরে। তাদের সন্দেহ ছিল, এরাই এসব পাকিস্তান বিরোধী কাজ করছে। এই পরিবারগুলোকে তো আর এমনিতেই ছাড় দেয়া উচিত হবে না ভেবে, এই ক্ষুদে গেরিলারা বিভিন্ন সময় তাদের ‘লাল চিঠি’ দিয়ে ভয় দেখাত। লাল কালিতে লেখা সে চিঠিগুলো নিয়মিতভাবে পাকিস্তান পন্থীদের বাড়ির দরজায় দরজায় ফেলে আসা হতো। এভাবেই যুদ্ধের নয় মাস জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিচ্ছু মেয়েরা চালিয়ে গেছে তাদের যুদ্ধ। অস্ত্র হাতে নয়, সে যুদ্ধ ছিল কলম হাতে।
পাকিস্তানি শিশু
লিনু হকের জবানিতে সেসময় বাঙ্গালিদের ব্যাপারে পাকিস্তানিদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনার একটা চিত্র উঠে আসে। ঠিক কী কারণে উনি ছেলেবেলা থেকেই পাকিস্তান শাসক শ্রেণির প্রতি বিরুপ চিন্তা নিয়ে বড় হয়েছেন আর ছেলেবেলার কোন ঘটনা তার মনে গভীর দাগ কেটেছে, এই প্রশ্নের উত্তর ছোট্ট একটি গল্প।
প্রতিদিনের মতো লিনু হক আর তার বান্ধবীরা মাঠে খেলা করছিলেন। তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই, মাগরিবের আযানের শব্দ ভেসে আসলেই খেলা বন্ধ করে ছুটতে হবে বাড়ির দিকে। এমন সময় প্রতিবেশী এক পাকিস্তানি কর্মকর্তার সমবয়সী মেয়ে এসে খেলতে চাইল। বাঙ্গালি মেয়েরা তাকে বুঝিয়ে বলল, খেলা শেষের দিকে, আগামীকাল তাকে নিয়ে খেলা হবে। এমন সময় আড়াল থেকে শিশুটির মা বেড়িয়ে এসে কন্যাকে আদেশ দিল: ‘গেম কোর্টপে মুত দো (খেলার কোর্টে প্রস্রাব করে দাও)।’ শিশুটি সাথে সাথেই মায়ের আদেশ পালন করল। এরপর, স্তম্ভিত মেয়েদের সামনে পাকিস্তানি মা আর মেয়ে বাংলাদেশিদের নিয়ে উর্দুতে কিছু ব্যঙ্গাত্মক ছড়া কেটে বাড়ির পথ ধরল।
ক্ষোভে, অপমানে লিনু হকরা বাড়ি ফিরে বাবার কাছে নালিশ দিলেন, এর একটা বিচার চাইলেন। উত্তরে বাবা বললেন, আমরা ওদের বিচার করার ক্ষমতা রাখি না কারণ ওরাই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই কথাটাই লিনু হকের শিশু মনে গভীর দাগ কেটে গেল। উনি তখনই উপলব্ধি করলেন একমাত্র দেশ স্বাধীন হলেই এই তাচ্ছিল্য থেকে মুক্তি আসবে।
মাঝির স্ত্রী
মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান আর ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বললেন, ‘মা দশমাস দশদিন সন্তান পেটে ধরে, প্রসব বেদনা সহ্য করে সন্তান জন্ম দেয় আর সেই সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানের মুখ দেখে সব ব্যথা, যন্ত্রণা এক নিমিষেই ভুলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিটি নারী এই মায়ের ভূমিকায় চলে আসে। তারা নয়মাস ধরে নানারকম নির্যাতন সহ্য করে আর জীবনের সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে বাংলাদেশ নামে একটি শিশুর জন্ম হবে বলে। পৃথিবীর মানচিত্রে যখন বাংলাদেশের জন্ম হলো, এই নারীরা নিজেদের সব কষ্টের কথা ভুলে গেল। বাংলাদেশ পেয়েই তারা খুশি, তাদের আর কিছুরই প্রয়োজন ছিল না, তারা কোন প্রতিদান দাবি করল না।’
এরকম একজন খুব সাধারণ নারীর গল্প বললেন লিনু হক। উনি একজন মাঝির স্ত্রী। পাকিস্তান আর্মির তাড়া খেয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা নদীর পাড়ে এসে থমকে গেলেন। সামনে যাওয়ার উপায় নাই, কারণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোন মাঝিই তাদের নদী পার করতে রাজি নয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখন জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছেন, তখন বটি হাতে ছুটে এলেন এক নারী, এক মাঝির স্ত্রী। স্বামীর গলায় বটি ধরে বললেন, এক্ষুনি নৌকা ছাড়বি, নতুবা তোর গলা আমিই কাটবো। উপায় না দেখে মাঝি নৌকা ছাড়ল, বেঁচে গেল অন্তত বারোজন মুক্তিযোদ্ধার প্রাণ।
লিনু হক বললেন, যুদ্ধ শেষে এই মাঝির বা তার স্ত্রীর খবর কেউ রাখেনি। তারাও তো কোন দাবি নিয়ে সামনে আসেনি। বাংলাদেশের প্রতিটি নারীরই এরকম কিছু না কিছু ভূমিকা ছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রামে।
আহত পাকিস্তানি নারী
পঁচিশে মার্চের ভয়াল কালরাতে চারদিক থেকে ভেসে আসছে গোলাগুলি আর মানুষের আর্তচিৎকারের শব্দ। আজিমপুর সরকারি কলোনিতে পাকিস্তান হানাদাররা কোন অপারেশন চালায়নি সে রাতে। তবে, মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয় হওয়ায় এক দম্পতিকে তুলে নিয়ে যায় তারা। এছাড়া আর তেমন কোন সমস্যা হয় না। কলোনির বাসিন্দারা সারারাত খাটের নিচে শুয়ে পার করে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে আশেপাশের বাড়িঘর, বস্তিতে আগুন দেয়া হয়েছে। সেই আগুনে রাতের বেলায় দিনের মতো চারদিক পরিস্কার দেখা যাচ্ছে আর কানে আসছে নারী-শিশু-পুরুষের করুণ আর্তনাদ। এভাবে, উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রাত পার হলো সবার।
ভোরের আলো ফুটল কিন্তু সেই পরিচিত কোলাহল শোনা গেল না। চারদিক স্থবির, সকালের পত্রিকা এল না, পরিচিত গোয়ালাও এল না দুধের পাত্র নিয়ে। ২৬ মার্চ সকালে বাড়ি থেকে দুধের বালতি নিয়ে লোকটি বের হয়েছিল ঠিকই তবে বেশিদূর এগোতে পারেনি। বাড়ি থেকে কয়েকগজ দূরে যেতেই হিন্দু লোকটি পাকিস্তান আর্মির সামনে পড়ে যায় আর তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়। এই ঘটনা অবশ্য কলোনির গ্রাহকরা জানতে পারে আরো কয়েকদিন পরে।
এদিকে সকালে দুধ না পেয়ে কলোনির এক পাকিস্তানি কর্মকর্তার স্ত্রী খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গোয়ালার অপেক্ষায় থেকে বিরক্ত হয়ে নিজেই পাত্র হাতে বের হয়ে এলেন বাসা থেকে। কলোনির কিছু দূরেই গোয়ালার বাড়ি। উনি সেদিকেই যাবেন। তাকে বের হতে দেখে প্রতিবেশীরা বাধা দিতে এলে তিনি খুব দম্ভ করে বললেন, ‘আমরা পাকিস্তানি, তোমাদের মতো বাঙ্গালি নই, আমাদের কোন ভয় নাই। কেউ আমাদের চুলটিও স্পর্শ করার সাহস দেখাবে না।’
দুধের পাত্র হাতে উনি কলোনির প্রধান ফটক অবধি পৌঁছে গেলেন। ফটকের বাইরে পা বাড়াতেই একটা বুলেট এসে তাকে বিদ্ধ করল। ফটকের সামনে পড়ে কাতরাতে লাগলেন পাকিস্তানি নারীটি। তার এই অবস্থা দেখে বাঙ্গালি ছেলেরা আর ঘরে বসে থাকতে পারল না। তারা নিজের জীবন বাজি রেখে হামাগুড়ি দিয়ে ফটকের কাছে চলে গেল। কোনরকমে ছেঁচড়ে পাকিস্তানি নারীটিকে ভেতরে নিয়ে এল। এরপর বাঙ্গালিদের সেবায় সে নারী সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
লিনু হক বললেন, ‘দ্যাখো আমরা বাংলাদেশিরা অমানবিক ছিলাম না। মানুষের বিপদে আমরা ঘরে বসে থাকতে পারিনি কোনদিনও। এই মানুষের উপরে অত্যাচার দেখেই কিন্তু আমরা যুদ্ধ করেছি কিন্তু পাকিস্তানিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়েও তাদের আমরা ক্ষতি করিনি। এটাই সেসময় বাঙ্গালির আদর্শ ছিল।’
‘আজ স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে শুনতে হয়, বাঙ্গালিরাই নাকি উল্টা পাকিস্তানিদের অত্যাচার করেছে। তখন কথাগুলো বুকে এসে আঘাত করে। হতাশায় ডুবে যাই। আবার তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের দেখে আশায় বুক বাঁধি। মুক্তিযোদ্ধারা যদি বটগাছ হন, তোমাদের প্রজন্মের মানবিক মানুষরা তার নিচে বেড়ে ওঠা নতুন চারাগাছ। আবার সেখানে আগাছাও থাকবে খুব স্বাভাবিক। তোমরা তোমাদের শিক্ষা, জ্ঞান আর মানবতা দিয়ে সেই আগাছাগুলো উপড়ে ফেলবে, সেটাই তোমাদের প্রতি আমাদের অর্পিত দায়িত্ব।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে