নির্বাচন কেমন হবে সরকারকে কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। সেটি হবে মহোৎসবের নির্বাচন, যদি আমরা ঐকমত্যের মাধ্যমে ফয়সালা করতে পারি। এই নির্বাচন শুধু নির্বাচন নয়, এটি হবে জাতির নবজন্ম।’ গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান সংলাপে তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আবারও নিজের এই দৃঢ় অবস্থান ঘোষণা করেন।
এর এক সপ্তাহ আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘নির্বাচন যে করেই হোক ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই এই নির্বাচনকে ঠেকাতে পারে। সে জন্য যত প্রস্তুতি লাগে সেগুলো নেওয়া হচ্ছে।’ এর পাঁচ দিন আগে গত ২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাতটি রাজনৈতিক দল ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রেস সচিব জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বাধা ও ষড়যন্ত্র হতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যতভাবে পারবে, বাধা দেবে। তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কাজ করবে এবং নির্বাচন বানচাল করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির পথে এরই মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন শফিকুল আলম।
এর ঠিক দুদিন আগে ৩১ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বৈঠক শেষে প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
সরকার প্রধানের এসব বক্তব্যের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তার দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা ফুটে ওঠে; কিন্তু তা সত্ত্বেও আগামী ফেব্রুয়ারিতে সত্যিই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে তো বটেই, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংশয় আছে। স্বয়ং সরকারপ্রধানের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরেও এই সংশয় বা অনাস্থার পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে। যে কারণে পৃথিবীর কোনো শক্তি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না- এমন বক্তব্যের বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
এই কথা শুনে মনে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার। কথাটি হয়তো প্রতীকী অর্থে বলা হয়েছে- যার মধ্য দিয়ে সরকার নির্বাচন নিয়ে তার আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা প্রকাশ করতে চেয়েছে। কিন্তু গত এক বছরে সরকার তার দক্ষতার কী প্রমাণ রাখতে পেরেছে যার মধ্য দিয়ে এটা বিশ্বাস করা যায় যে, পৃথিবীর কোনো শক্তি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না?
পৃথিবীর কোনো শক্তি তো বটেই, দেশের অভ্যন্তরে এখন যেসব শক্তি ক্রিয়াশীল- তাদের মধ্যে কোনো একটি বা দুটি শক্তি যদি নির্বাচন ঠেকাতে চায়, সরকার তাদের প্রতিহত করতে পারবে? যার একটি ছোট পুকুর সাঁতরে ওপারে যাওয়ার দম নেই, তিনি যদি উত্তাল নদী পার হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয় না।
গত এক বছরে এই সরকার শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় কিছু দুষ্টু লোক- যারা মব তৈরি করে নানা ধরনের সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে, তাদেরকেই প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি মবের ঘটনার পরে সরকারের তরফে নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। কিছুদিন পরে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বারবার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে; কিন্তু মব থামেনি। বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে মব তৈরি করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর আক্রমণ হয়েছে। চাঁদা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার তাদের সুরক্ষা দিতে পারেনি। মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের পরে এবার কবর থেকে লাশ তুলে তাতে আগুন দেয়ার মতো নারকীয় ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার পরেও সরকারের তরফে বিবৃতি এসেছে।
প্রশ্ন হলো, এক বছর ধরে এই ধরনের কাজ চলছে কীভাবে? সরকার এদের প্রশ্রয় দিচ্ছে নাকি এদের ভয় পায়? নাকি যারা মব সৃষ্টি করে সরকার তাদের ক্ষেপাতে চায় না অথবা সরকার ভাবে যে, মব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সত্যিই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করলে তারা সরকারের বিরুদ্ধেই মব তৈরি করবে?
যদি তাই হয়, তাহলে নির্বাচন ঠেকাতে এই একটি গোষ্ঠীই কি যথেষ্ট নয়? এর বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপে নিয়মিত হুমকি দানকারী ব্যক্তি ও সংগঠন এবং দেশের বাইরে থেকে প্রতিহিংসা ও সহিংসতায় উসকানিদাতাদের যে বিরাট সমর্থকগোষ্ঠী ও অনুসারী তৈরি হয়েছে- একটা নির্বাচন বানচাল করা বা নির্বাচনকে সমস্যাসংকুল করে তুলতে তারাও নানা ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে বা গত এক বছরে কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
এই মুহূর্তে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুধু বিএনপিই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে অনেক বেশি সোচ্চার; কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নে বাকি তিনটি দল জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান ভিন্ন। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন, পিআর বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন, নির্বাচনের আগে জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও সংস্কার সম্পন্নের দাবিতে অটল। এমনকি কোনো কোনো দল এই হুঁশিয়ারিও দিয়েছে যে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আগামী নির্বাচনে অংশহণের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ধরা যাক জাতীয় পার্টিকেও ভোটের বাইরে রাখা হলো। এমতাবস্থায় জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ যদি নির্বাচন বয়কট করে, তাহলে বড় দলগুলোর মধ্যে ভোটের দাবিতে সোচ্চার থাকবে শুধু বিএনপি। সরকার শুধু বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজন করবে?
এগুলো হচ্ছে অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ব্যাপার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব শক্তিশালী দেশের স্বার্থ আছে, সেসব দেশ যদি নির্বাচন ঠেকাতে চায়, সরকার কী করবে? অনেকের মনেই এই ধারণা আছে যে, আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে আমেরিকার হাত ছিল। যদি এই অভিযোগ সত্য হয় এবং আমেরিকা যদি কোনো কারণে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঠেকাতে চায়, অন্তর্বর্তী সরকার তা উপেক্ষা করে নির্বাচন করে ফেলতে পারবে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে চায়নার অনেক স্বার্থ রয়েছে। তারা যদি নির্বাচন ঠেকাতে চায় বা বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী দেশ যে ভারত এখন পৃথিবীর অন্যতম বড় শক্তি, তারাও নির্বাচন ঠেকাতে চায়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? কেননা, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কারা সরকার গঠন করবে, তাদের সঙ্গে বিশ্বের এই শক্তিগুলোর কেমন সম্পর্ক হবে- সেসব অঙ্কও গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক শক্তিকেই যখন সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে হয়, সেখানে পৃথিবীর কোনো শক্তি নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না- এই কথা শুনতে যতটা ভালো, বাস্তবে ততটা নয়। বরং এই সরকারের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যদি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়েও যায়, তারপরও এটি শেষ পর্যন্ত কেমন নির্বাচন হবে- তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।
পরিশেষে, একটি নির্বাচন কেমন হবে তা নির্ভর করে ওই সরকার কী চায় এবং সরকার কতটা শক্তিশালী তারওপর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো সত্যিই চায় যে তারা ফেব্রুয়ারিতে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেবে, কিন্তু এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য সরকারের যে দক্ষতা প্রয়োজন, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। সরকারের ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পৃথিবীর কোনো বড় শক্তি তো বটেই, অভ্যন্তরীণ অনেক শক্তিই নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং, কথায় নয়, সরকারকে কাজ দিয়েই নিজেদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে