চাপে পড়ে সরকারকে নমনীয় হলে চলবে না
ঢাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। গত কয়েক বছর ধরেই বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা প্রথম থেকে পঞ্চমের মধ্যেই থাকে। শীতকালে তা বাড়ে। এখন ঘনঘন বৃষ্টি হয় বলে বায়ুদূষণের মাত্রা একটু কম। তাও গতকাল (২৪ সেপ্টেম্বর) বায়ুদূষণে বিশ্বের ১২৭টি নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান পঞ্চম। রাজধানীর এই বায়ুদূষণের মাত্রা লাগামছাড়া থাকার একটা বিশেষ কারণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল।
ঢাকার আকাশ প্রতিদিন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। রাজধানীর সড়কে পুরোনো, ফিটনেসবিহীন ও ধোঁয়া উগরে দেওয়া হাজারো গাড়ি বায়ুদূষণের অন্যতম বড় উৎস হয়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকার মোট বায়ুদূষণের অন্তত ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী এসব লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি। চিকিৎসকদের মতে, এতে নগরবাসীর মধ্যে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আইন অনুযায়ী ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস-মিনিবাস ও ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক-কাভার্ডভ্যান সড়কে চালানো যায় না। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনের প্রভাব ও বিআরটিএর অনিয়মের কারণে এসব গাড়ি নির্দ্বিধায় চলছে। সরকারি হিসাবেই দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের সংখ্যা ৪১ হাজারের বেশি এবং বাস-মিনিবাসের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে বহু গাড়িরই ফিটনেস নেই।
গত জুলাইয়ে সরকার ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদে অভিযান শুরু করলেও পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটের হুমকি দিলে অভিযান স্থগিত হয়। উল্টো সরকার মালিকদের দাবির মুখে নতুন সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে রিকন্ডিশন্ড বাস ও ট্রাক আমদানির বয়সসীমা পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরোনো গাড়ি মালিকদের স্বল্পসুদে ঋণ ও কর-সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নীতি শিথিল করলে পুরোনো গাড়ির দৌরাত্ম্য আরও বাড়বে।
পরিবহন বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার যদি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কেবল মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় নীতি গ্রহণ করে, তবে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। তাদের মতে, পুরোনো গাড়ি বাজার থেকে তুলে না নিলে সড়কের নৈরাজ্যও কোনোভাবেই কমবে না।
গতকাল বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, খোদ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকেই কালো ধোঁয়া নির্গত গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়া দেয়া। আবার অনেক গাড়ি বছরের পর বছর ফিটনেস সনদ না নিয়েও অবাধে চলাচল করছে ঢাকার রাজপথে। চাপে পড়ে গাড়ি মালিকদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে সরকার। গাড়ির মালিক-শ্রমিকের ধর্মঘটের হুমকিতেই ভেস্তে গেল পুরোনো গাড়ি উচ্ছেদ অভিযান।
এখন, এভাবে যদি চলতে থাকে, কোনো বিশেষ পক্ষের হুমকিতে যদি সরকার ভয় পেয়ে যায় তাহলে তো রাষ্ট্রের কোনো কিছুই ঠিক করা যাবে না। এর আগে ঢাকার রাস্তায় অটো-রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করতে গিয়েও অটো-রিকশা চালকদের বিক্ষোভের মুখে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ যেন আর বিশেষ গোষ্ঠীর মব-এর রাজত্ব। কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধেই সরকার কিছু করতে পারছে না। যেখানে দরকার সরকারের কঠোরতা সেখানে সরকার একটু চাপেই নমনীয় হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে রাজধানী ঢাকা দিন দিন বসবাস-অযোগ্য হচ্ছে। আমরা চাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য যা ভালো হবে সরকার যথাযথ বিবেচনায় সেরকম সিদ্ধান্তই নিবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধের কথা বহুদিন ধরেই হচ্ছে, এখনো কেন সরকার তার কোনো বিহীত করতে পারছে না তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
কতিপয় স্বার্থগোষ্ঠীর হাতে সমগ্র নগরবাসীকে অস্বাস্থ্যকর এক জীবনের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাই আমরা সরকারকে সরাসরি বলতে চাই, চাপে পড়ে সরকারকে নমনীয় হলে হবে না, প্রয়োজনে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। যে করেই হোক ফিটনেসবিহীন গাড়ি উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে