Views Bangladesh Logo

প্রকাশ্যে রাস্তায় সাংবাদিক খুন ও নির্যাতন

সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের ভূমিকা হতাশাজনক

কি ভয়ংকর দৃশ্য! প্রকাশ্য রাস্তায় একদল তরুণ একজন মানুষকে কুপিয়ে, গলা কেটে খুন করছে! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেল অনেকটা উৎসবের আমেজে খুন করা হচ্ছে একজন মানুষকে। যদি খুনিদের মুখে রাগের চিহ্ন থাকত, তবু বলা যেত, এটা কোনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ; কিন্তু এই হাসিমুখ ভয়ংকর খুনিদের আমরা কী বলব? আর একটি ভিডিওতে দেখা গেল একজন সাংবাদিককে পুলিশের সামনেই একদল তরুণ এলোপাতাড়ি মারধর করছে। পাথর দিয়ে থেঁতেলে দিচ্ছে শরীর। প্রকাশ্য রাস্তায় এমন নৃশংস খুন, মারধরের দৃশ্য যে কোনো সংবেদনশীল মানুষেকে বাকরুদ্ধ, হতভম্ব করে দেয়। যাকে খুন করা হয়েছে এবং যাকে মারধর করে গুরুতর আহত করা হয়েছে, তারা দুজনেই স্থানীয় সাংবাদিক। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম নয়; কিন্তু প্রকাশ্য রাস্তায় শত শত মানুষের সামনে সাংবাদিক খুনের ভয়ংকর দৃশ্য এবারই প্রথম দেখা গেল।


আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, এতবড় খুন ও নির্যাতদনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কেউই কোনো বক্তব্য দেননি। খুনিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে আশ্বস্ত করেননি। খুনিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ‘গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে’ বলে গতানুগতিক দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। প্রকাশ্য রাস্তায় এতবড় খুনের ঘটনার পর সরকারের এ অভূতপূর্ব, অকল্পনীয় নির্লিপ্ততা দেশের মানুষের মনে আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। পুলিশের দায়সারা অভিযানের কারণে প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার নিয়ে বড় ধরনের সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

লজ্জাজনক হচ্ছে, দেশে একের পর এক এ ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটছে; কিন্তু আগে যেসব মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠন গুম, খুন, হেফাজতে নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সোচ্চার ছিল, তারা আজ নিশ্চুপ। প্রকৃতপক্ষে দেশের বিদেশি অনুদাননির্ভর মানবাধিকার সংগঠনের তৎপরতাও এখন চোখে পড়ে না বললেই চলে। জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনও প্রায় এক বছর ধরে অকার্যকর।

একই সঙ্গে আগে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সোচ্চার থাকতে দেখা গেছে। এখন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ দখল নিয়ে ব্যাপক তৎপর দেখা গেলেও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় নিশ্চুপই দেখা যাচ্ছে। ফলে দেশে পেশাদার সাংবাদিকতা বড় ধরনের ভয় ও হুমকির মধ্যে পড়েছে। গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের ঘটনা দেশের সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিকতাকে আরও বেশি আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, অথচ সাংবাদিক নেতৃত্বের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

পুলিশের ভাষ্যে জানা গেছে, খুন হওয়া সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন একদল ছিনতাইকারী কিংবা সন্ত্রাসীর সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ড ভিডিও করার সময় উত্তেজিত সন্ত্রাসীরা তাকে খুন করেছে। আর নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আনোয়ারকে কারা মারধর করেছে, কারা শরীর থেঁতলে দিয়েছে, তাদের বিষয়ে পুলিশের সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে এ ঘটনায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম হয়েছিল, ‘বিকেলে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে লাইভ, রাতে সাংবাদিক হত্যা’ এবং ‘চাঁদাবাজির খবর প্রকাশের কারণে সাংবাদিককে প্রকাশ্যে মারধর’। পুলিশের ভাষ্যে সে শিরোনাম পরে অনেক সংবাদ মাধ্যমেই বদলে গেছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তায় এভাবে প্রকাশ্যে ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে? এ স্বাধীনতা তাদের কে দিয়েছে? তাহলে কি গাজীপুরে পুলিশ, প্রশাসন নেই? ভিডিওতে যারা সাংবাদিককে খুন করেছে এবং মারধর করেছে তাদের চেহারা একদম স্পষ্ট। অথচ পুলিশ তাদের পরিচয় জানে না, এটা অবিশ্বাস্য।  দেশের মানুষ জানে, বাংলাদেশে এভাবে প্রকাশ্য রাস্তায় বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মেতে উঠতে পারে কেবল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সন্ত্রাসীরা। কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগত না হলে সন্ত্রাসীরা এভাবে প্রকাশ্যে উল্লাস করে খুনে মেতে উঠতে পারে না।

অন্ধকারের ছিনতাইকারীর সন্ত্রাসের ধরন আর এ সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের ধরন এক নয়। তাহলে এই সন্ত্রাসীদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করা হচ্ছে কেন? যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে এই সন্ত্রাসীদের আড়াল করা হয়, রক্ষা করা হয়, তাহলে সেই রাজনৈতিক দলের জাতীয় নেতৃত্বকেও অদূর ভবিষ্যতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পতিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিণতিই ভোগ করতে হবে, সন্দেহ নেই। তাই জাতীয় নেতৃত্বের উচিত হবে নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে সন্ত্রাসীদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়া এবং এই সন্ত্রাসীদের স্থানীয় গডফাদারদের আগামী নির্বাচনে কোনোভাবেই দলীয় মনোনয়ন না দেয়া।

আমরা সরকারকে বলতে চাই, যেহেতু সরকারে আছেন, জনগণের করের টাকায় সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, সে কারণে এ ধরনের নৃশংস ঘটনার দায় যেমন আপনাদের কাঁধেই বর্তায়, তেমনি এই খুনিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্বও আপনাদের। সন্ত্রাস দমনে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের সেই দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না, এটাই চরম হতাশার। আমরা আশা করব, গাজীপুরে সাংবাদিক খুন ও নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে সরকার দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ