গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা: আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারে যাত্রী
গত ১ মাস ধরে বিশ্ববাসীর চোখ আটকে ছিল এক আলোকময় নৌবহরের দিকে। নৌবহরের নাম ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’। এবার গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার প্রথম বহর ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৩ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়া ও ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে আরও নৌযান এ বহরে যুক্ত হয়। এ ছাড়া গ্রিসের সাইরাস দ্বীপ থেকে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু নৌযান ত্রাণ নিয়ে বহরে যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত বহরটিতে ছিল ৪০টির বেশি নৌযান। প্রায় ৪৪টি দেশের ৫০০ মানুষ ছিলেন এ বহরে।
তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিক। তারা দুর্ভিক্ষের শিকার ক্ষুধার্ত ও বোমার আঘাতে আহত গাজাবাসীর জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন খাদ্য ও চিকিৎসার ত্রাণসামগ্রী। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলও যেখানে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছাতে পারে না! মানুষ আশা করেছিল আগে কয়েকবার ব্যর্থ হলেও এবার সুমুদ ফ্লোটিলা পৌঁছাতে পারবে গাজা সীমান্তে; কিন্তু গতকাল (২ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ১টি ছাড়া আর সব জাহাজই আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শত শত অধিকারকর্মীসহ সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গকেও আটক করেছেন ইসরায়েলি সেনারা।
বেশ কয়েকটি দেশ এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে তুরস্ক, কলম্বসহ কয়েকটি দেশ। ইসরায়েল এ নৌবহরকে ‘উসকানিমূলক হিসেবে দাবি করেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে আটক মানবাধিকার কর্মীদের শিগগির ইউরোপ পৌঁছে দেয়া হবে। এই নৌবহরে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ‘দৃক’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালন ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। মাঝে মাঝে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাত্রাপথের খবরাখবর জানাতেন। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা যাচ্ছেন। একবার ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন। তার শেষ ভিডিও বার্তায় দেখিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনী তাদের নৌবহর লক্ষ্য করে গুলি ও মিশাইল ছুড়ছে। শহিদুল আলমের আর কোনো খবর জানা যায়নি তারপর। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন গ্রেটা থুনবার্গসহ আটক সবাই সুস্থ আছেন।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এও জানিয়েছেন, গাজায় অবস্থিত সব গাজাবাসীকে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব গাজা ছেড়ে চলে যেতে হবে। এখনো হাজার হাজার গাজাবাসী গাজায় অবস্থান করছেন। যারা গাজায় থাকবে, তাদেরই সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এবং তাদের ওপর আক্রমণ চলতে থাকবে। গত বুধবার সকালের আক্রমণে আরও ৭৪ গাজাবাসী মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রতিদিনিই গাজায় কমপক্ষে ১০০ জন মারা যাচ্ছেন, হয় ইসরায়েলি বাহিনীর মিশাইলের আক্রমণে, না হয় ক্ষুধায়।
জাতিসংঘ শুধু এ ঘটনাকে লজ্জাজনক বলেই ক্ষান্ত। গাজাবাসীদের নির্বিচারে হত্যা যদি জাতিসংঘ বন্ধই করতে না পারে, দুর্ভিক্ষকবলিত গাজায় যদি তারা সাহায্য পৌঁছে দিতে না পারে, হলে জাতিসংঘ আছে কী জন্য? গাজায়, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর এই নির্লজ্জ আক্রমণ জাতিসংঘের ব্যর্থতাকেই চিহ্নিত করে। আরও দুঃখজনক বিষয়, তুরস্ক ও ইরান ছাড়া বেশির ভাগ মুসলিম দেশই এ ব্যাপারে নীরব। অথচ, গাজামুখী নৌবহরের বেশির ভাগ মানবাধিকার কর্মীরাই মুসলিম দেশের নয়। এটাও মুসলিম দেশের জন্য একটা লজ্জাজনক ইতিহাস হয়ে থাকবে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা প্রমাণ করল, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কোনো জাতিধর্মের হতে হয় না, মানুষ হলেই হয়।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা হয়তো এবারও ব্যর্থ হলো; কিন্তু এবার তারা যে সাড়া ফেলেছে, তাকে ব্যর্থ বলা যায় না। এতে নতুন করে অনেক দেশের মানুষেরই বিবেক জেগে উঠেছে। ফিলিস্তিন একদিন স্বাধীন হবেই। হয়তো স্বাধীন হতে হতে গাজাবাসী সম্পূর্ণ নির্মূল, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারপরও ইতিহাসের খাতায় এ কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে, গহিন অন্ধকারের মধ্যেও সমুদ্র প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে একদল মানুষ গাজার বিধ্বস্ত ভূমিতে পৌঁছুতে চেষ্টা করেছিল। কবি গুরুর ভাষায়: আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারে যাত্রী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে