বেওয়ারিশ লাশের কবরের জায়গা দিন
মৃত্যু প্রাণের এক করুণ ও অনিবার্য নিয়তি। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের মৃত্যু নয়! মানুষের মৃত্যু সম্মান-সৎকার দাবি করে। সেটা যখন অনেকের জন্য জোটে না তার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য কারও নেই। মৃত্যুর পরও তাদের ভাগ্যে জোটে না প্রিয়জনের বিলাপ। নাম-পরিচয়হীন এসব লাশ চিহ্নিত হয় ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে। হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকে তারা অবহেলায়। বেওয়ারিশ লাশ দাফনকারী সেবামূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সহযোগিতায় রাজধানীর অনেক বেওয়ারিশ লাশের দাফন হয়; কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনের অনড় অবস্থানের কারণে এবার অনেক বেওয়ারিশ লাশের কবরের জায়গাও জুটছে না। কারণ, লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফন করলেও তার জন্য খরচ ও কবরের জায়গা দেয় দুই সিটি করপোরেশন।
আজ (২৮ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমের তথ্যে জানা যায়, এ ধরনের লাশ দাফনের বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, তিন ভাগের এক ভাগের বেশি বেওয়ারিশ লাশ তারা জুরাইন কবরস্থানে দাফন করতে দেবে না। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, ডিএনসিসি এলাকার বাইরের কোনো বেওয়ারিশ লাশ যেন রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা না হয়। এমন নিয়মে বিপাকে পড়ছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
আর অন্যদিকে দিন দিন বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, তারা গত বছর (২০২৪) বেওয়ারিশ ৫৭০টি লাশ দাফন করেছে। গত ৭ মাসে দাফন করেছে ৩৬৪টি। কবরের জায়গা পাওয়া না পাওয়ার কারণে বেওয়ারিশ লাশগুলো মর্গে পড়ে পচছে। কারও হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেলেও লাশ শনাক্ত করতে আসছে না কেউ।
সাধারণত দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে, অসুখে-বিসুখে-বার্ধক্যে ভোগে এসব অচেনা লাশগুলো রাস্তায় পড়ে থাকে। পুলিশ লাশগুলো তুলে নিয়ে মর্গে রাখে। পুলিশের সঠিক তদন্তে গাফিলতি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সার্ভারে তাদের তথ্য না থাকায় লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা যায় না। গত মঙ্গলবারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিএসসিসির আওতাধীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে পড়ে আছে ২০টি বেওয়ারিশ লাশ আর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ৫টি। লাশ দাফনের দুই সিটি করপোরেশনের নিয়মের ফয়সালা না হলে মর্গে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। তখন লাশ রাখার জায়গা সংকটে পড়বে মর্গ কর্তৃপক্ষ।
তাহলে লাশগুলো যাবে কোথায়? চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মানুষের কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনা ও প্রাকটিক্যাল করতে হয়। যে কারণে বেওয়ারিশ লাশের বড় একটি অংশ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাজে আসে।
দেশে বর্তমানে ২৭টি সরকারি এবং ৭২টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। প্রতিটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা-উপকরণ হিসেবে কঙ্কাল বা হাড়গোড় সংগ্রহ করতে হয়। এই কঙ্কালের অন্যতম উৎস হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ। ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক এক চিকিৎসকের দেয়া তথ্যমতে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা অবৈধ পন্থায় বেওয়ারিশ লাশ ও কঙ্কাল বিক্রি করা হয়। এর প্রধান ক্রেতা হচ্ছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেশিরভাগ লাশ বিক্রির সঙ্গে জড়িত মর্গের নিয়োগপ্রাপ্ত ও চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীরা।
কিন্তু এটা কোনো আইনি পদ্ধতি নয় এবং বিষয়টি খুবই অমানবিক। শিক্ষার্থীদের কঙ্কাল সংগ্রহের পদ্ধতিটিও বৈধ হওয়া উচিত। অনেকে স্বেচ্ছায় লাশ দান করে দেয় চিকিৎসাসেবায়। সেগুলো আইনি ও বৈধভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে যেতে পারে; কিন্তু বেওয়ারিশ লাশ এমন অবৈধ বাণিজ্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর বেওয়ারিশ লাশ যদি দাফন না হয় তাহলে এ ধরনের অবৈধ কাজও বাড়তে থাকবে।
তাই দুই সিটি করপোরেশনকে এ নিয়ে অবশ্যই একটি সমঝোতায় আসতে হবে। মানুষের মৃতদেহের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান দেখানোর জন্য তাদের কবরের জায়গা দিতে হবে। মৃত্যুর পর একজন মানুষের মরদেহ যদি কবরের জায়গাও না পায় তার চেয়ে অসম্মানজনক তার জন্য আর কিছু নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে