শুভ জন্মদিন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
‘প্রতিটা মিনিট এই পৃথিবীকে উপহার দাও, বড় কিছু দিয়ে’

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে একজন শিক্ষক, কবি, কথাসাহিত্যিক, সংগঠক, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী, টেলিভিশন ব্যক্তিত্বের অবয়ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে তার অনেক বক্তব্য ভাইরাল হয়, যে বক্তব্যগুলো অসাধারণ শিক্ষামূলক ও জ্ঞানগম্ভীর। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা, শিক্ষকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠনসহ জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় যার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে বাধ্য করে শ্রোতাকে। তিনি যখন কথা বলেন, সবাই তার কথা মুগ্ধ হয়ে শোনেন।
যেন তিনি বলেন, বাকিরা শোনেন। তার কথায় পর্যালোচনা থাকে, বিশ্লেষণ থাকে; এক আশ্চর্য জাদুকরী ভাষায় তিনি মুগ্ধ করে রাখেন আমাদের। তিনি প্রায়ই বলেন, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়; কিন্তু তিনি যেন স্বপ্নের চেয়েও বড়; তা তিনি বাস্তবেই দেখিয়ে দিয়েছেন। তার আজীবনের স্বপ্ন শিক্ষকতা। সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক বটে। তিনি নিজেও সেটি দাবি করেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি যত কাজই করেছি মূলে কিন্তু আমি একজন শিক্ষক। যে তার আশপাশের সবার সমৃদ্ধি কামনা করেন।’
একজন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার কথা শুনতে এত ভালো লাগে কেন?’ উত্তরে প্রশ্নকর্তাকে বলেছিলেন- ‘আমার জীবনের চেষ্টাই হচ্ছে সুন্দরকে খোঁজা। আমার শরীর যদি একটু ভালো থাকে তখন আমি যে শব্দগুলো ব্যবহার করি, তা চেষ্টা করি আনন্দময় থেকে আরও আনন্দময় করে তোলার। আর একটি বিষয়- মানুষকে আমি কখনোই শক্তিমান মনে করি না। গম্ভীর কথা, ভারি কথা আমি নিজেও বুঝতে পারি না এবং টের পাই অন্যেরা তা বুঝতে পারে না। আর তাই সবসময় চেষ্টা করি কীভাবে সবচেয়ে সহজভাবে কথা বলা যায়।’
ইউটিউবে ভাইরাল এক বক্তব্য থেকে তার একটি কথা উদ্ধৃতি করা যাক, ‘আমরা যা হারিয়ে ফেলি, সেটা চিরজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলি। আমরা শৈশবকে একসময় হারিয়ে ফেলেছি। শৈশব বড় মিষ্টি সময়, বড় অনুভূতি ভরা সময়, বড় স্বপ্নে ভরা সময়। আমরা যত বয়সী হই না কেন, কেন যেন শৈশব আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। তার কারণ আমার একটি জিনিসই মনে হয়, মানুষ ততদিনই তরুণ, যতদিন সে শিশু। মানুষের মধ্যে এই শৈশবটাই হচ্ছে জীবন। শৈশবের কাছে ফিরতে চাওয়া মানে জীবনের কাছে ফিরতে চাওয়া।’
সায়ীদ স্যার প্রায়ই বলেন ‘থামো। দৌড়াও; কিন্তু থামতে শেখো। দাঁড়াতে শেখো। গাছ হতে শেখো। গাছের মতো সমুন্নত, গাছের মতো পোশাক-আবহ, গাছের মতো পাতায় ভরা, ফুলে ভরা, সৌন্দর্যে ভরা। তাহলে এই পৃথিবীতে সত্যিকারভাবে কিছু দিতে পারবে। তা না হলে হাততালি এবং শিস দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।’ আজীবন তিনি জনপ্রিয়তার চেষ্টায় দৌড়াননি। প্রায়ই তিনি বলেন ‘জনপ্রিয়তা খুবই নিম্নশ্রেণির জিনিস।’
সফলতা নিয়ে বলতেন, ‘সবাই শুধু সাফল্য সাফল্য বলে চিৎকার করে; কিন্তু আমার ধারণা সাফল্য খুব কাম্য জিনিস হলেও বড় জিনিস নয়। সাফল্য একটা দক্ষতা। চোর-বাটপারও অনেক সময় সফল হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের সফল লোকদের মাঝে ৮০ ভাগই তো দুর্বৃত্ত। এমন জিনিস নিয়ে পাগল হওয়ার কি আছে।’
তিনি প্রায়ই বলেন, ‘আজকাল আমাদের দেশে ভালো মানুষ বিচ্ছিন্ন। ভালো মানুষের মধ্যে যোগাযোগ নেই। তারা একা। তারা আলাদা ঘরে একা একা শুয়ে কাঁদে; কিন্তু যারা খারাপ, তারা কিন্তু খুবই সংঘবদ্ধ। এক শয়তান হুক্কাহুয়া দিলে মুহূর্তে হাজার শয়তান, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া করতে করতে এগিয়ে আসে। সেজন্য আমাদের দেশে দুর্বৃত্তরা ভালো মানুষের চেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে। তারা অনেক শক্তিশালী হয়েছে।’
সততার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্বৃত্তদের দেখে ভয় পেতে অভ্যস্ত; কিন্তু সততাও যে দুর্বৃত্তদের চাইতেও অধিক শক্তিশালী এটা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে সবচেয়ে বড় ট্যাগলাইন ‘আলোকিত মানুষ চাই।’ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি আলোকিত মানুষ খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এবং চিন্তাশীল সমাজ তৈরির লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। সেই থেকে চলতে থাকা পাঠচক্র, বইপাঠ উৎসব ও ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার আজ দেশের লাখো তরুণের মানস গঠনে প্রেরণা জোগাচ্ছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত বই পড়া কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের হাজার হাজার স্কুলপড়ুয়াকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন।
আলোর ইশকুল কার্যক্রমের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন ‘তোমরা সবাই বড় হও। নানা দিকে বিকশিত হও। চারদিকে তোমাদের আলোর ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে পড়ুক। জীবনকে মূল্যবান ভেব। প্রতিটা মিনিট এই পৃথিবীকে উপহার দাও, বড় কিছু দিয়ে, সুন্দর কিছু দিয়ে।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কর্মজীবনের শুরু ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। সাবলীল বক্তৃতা ও গভীর পাঠদৃষ্টি দিয়ে তিনি অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। তিনি সাহিত্যেও সমানভাবে অবদান রেখেছেন। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও আত্মজৈবনিক রচনায় তার কলম যেমন প্রখর, তেমনি স্নিগ্ধ। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার (২০০৪), একুশে পদক (২০০৫) ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১১)।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ চিরতরুণ একজন। তারুণ্য, কর্ম ও শক্তিতে বিশ্বাসী। তিনি তারুণ্যের তরুণ, বার্ধক্যের তরুণ, প্রতিটি সময়ের তরুণকে তিনি উপভোগ করেন। তাকে প্রকৃতই বাতিঘর বলা যায়। আমাদের কালের আলোকবর্তিকা তিনি।
আজ ২৫ জুলাই এই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন কলকাতার পার্ক সার্কাসে। সে হিসাবে ৮৬ বছর পূর্ণ করে ৮৭ বছরে পা দিলেন এই কিংবদন্তি শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
সম্প্রতি নিজের জন্মদিন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন ৮০ বছর। রবীন্দ্রনাথের সমান বাঁচলেই তিনি কৃতার্থ হবেন; কিন্তু স্যার সেই ৮০ পেরিয়ে এখন ৮৭-তে পা দিলেন। শুভ জন্মদিন স্যার। আপনি থাকবেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আমাদের মননে, চিন্তা, চেতনায়। আপনার ঋণ এই দেশের কাছে অবর্ণনীয়।
লেখক: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে