গাজায় নিহত বেড়ে ৫৭৮৮৮ জন, দুর্ভিক্ষের মুখে ২১ লাখ ফিলিস্তিনি
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন আরও ১০৪ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন অন্তত ৪২১ জন। নিহতদের ৪০ জনই মারা যান ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রে খাদ্য ও ত্রাণ আনতে গিয়ে।
এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত ২১ মাসে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৮৮৮ জনে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৩৮ হাজার ৯৭ জন। হতাহতদের ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারেরও বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।
এদিকে ইসরায়েলি সম্পূর্ণ অবরোধের ১০৩তম দিনে এসে গাজার সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, উপত্যকাটিতে এখনও ‘মাটি কামড়ে’ পড়ে থাকা ২১ লাখ ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে ছয় লাখ ৫০ হাজার শিশুও রয়েছে ‘লজ্জাজনক আন্তর্জাতিক নীরবতায়’ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত গাজার ৬৭ জন শিশু দুর্ভিক্ষে মারা গেছে এবং আরও প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধা’ ভোগ করছে।
ফিলিস্তিনি গণমাধ্যম ও গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের লাগাতার বোমাবর্ষণে শুক্রবার (১১ জুলাই) সারাদিনে ৩৯ জন নিহত ও অন্তত ২৩১ জন আহত এবং শনিবার (১০ জুলাই) ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত আরও ৬৫ জন নিহত ও অন্তত ১৮০ জন আহত হন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার হাসপাতালগুলোতে ৬১ জনের মৃতদেহ পৌঁছেছে এবং দুই শতাধিক আহত ফিলিস্তিনি নতুন করে ভর্তি হয়েছেন। হতাহতদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। তবে, অনেক মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে ও রাস্তায় পড়ে আছে। কিন্তু উদ্ধারকর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না।
তুর্কি সংবাদমাধ্যম টিআরটি জানায়, শুক্রবার নিহতদের মধ্যে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রের আশেপাশে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে মারা যান ১০ জন বেসামরিক নাগরিক। তারা দক্ষিণ গাজার রাফাহর উত্তর-পশ্চিমে আল-শাকুশ এলাকায় মানবিক সহায়তার অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে শনিবার নিহতদের ৩০ জন ভোরে একই ত্রাণকেন্দ্রে পুষ্টিকর খাবার বিতরণের লাইনে অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে আহত হন আরও ১৩০ জন।
ইসরায়েলি এবং মার্কিন-সমর্থিত সংস্থাটি যখন মে মাসে কার্যক্রম শুরু করে, তখন গাজাজুড়ে ২১ লাখ মানুষের জন্য চারটি বিতরণ কেন্দ্র ছিল, যেখানে পূর্বে জাতিসংঘ পরিচালিত ৪০০টিরও বেশি কেন্দ্র ছিল।
বুধবার (৯ জুলাই) থেকে রাফার শুধুমাত্র ওই একটি ত্রাণকেন্দ্র খোলা রেখে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য খান ইউনিসের তিনটি কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জিএইচএফ। ফলে উত্তরের অনেক ফিলিস্তিনি খাদ্যের প্রয়োজনে দক্ষিণে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের মৃত্যুর কারণ ও বিপজ্জনক বাধা তৈরি করছে।
গাজা থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানান, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বিশাল জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। আহতদের খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলেও অনেক মরদেহ এখনও মাটিতে পড়ে আছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, গত ছয় সপ্তাহে জিএইচএফের কেন্দ্রগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করার সময় কমপক্ষে ৮২৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও অন্তত পাঁচ হাজার ২৬২ জন আহত হন। তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, খাবার নিতে গিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের বারবার মৃত্যুর খবর পেয়ে সেনাদের প্রতি নতুন নির্দেশনা জারি করেছে তারা।
গাজার হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নাসের হাসপাতাল জানায়, দুদিনে ইসরায়েলি হামলার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল উত্তরে গাজা সিটির খান ইউনিসের পশ্চিমে তথাকথিত ‘মানবিক’ আল-মাওয়াসি এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের আবাসস্থলে, যেখানে কমপক্ষে নিহত হন ১৫ জন।
আল-আকসার শহীদ হাসপাতাল জানায়, মধ্য গাজা স্ট্রিপের দেইর এল-বালাহের দক্ষিণে বাস্তুচ্যুতদের আবাসস্থলে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় দু’জন নিহত এবং অনেকে আহত হন। কুদস নিউজ নেটওয়ার্ক এবং শেহাব সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, একই এলাকার বারাকা পেট্রোল স্টেশনে বোমা হামলা চালিয়ে কমপক্ষে চারজনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা। গাজা সিটির পূর্বে তুফা এলাকার জাফা স্ট্রিটের একটি বাসভবনে অন্য একটি হামলায় চারজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন।
ওয়াফা সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, গাজা সিটির পশ্চিমে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে জামাল আবদেল নাসের স্ট্রিটে বোমা হামলায় এক মা এবং তার তিন সন্তান নিহত হন।
আল-শিফা হাসপাতালের সূত্র অনুসারে, গাজা শহরের রেমাল এবং শেখ রাদওয়ান পাড়ায় পৃথক হামলায় আরও চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার রাফাহের পশ্চিমে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আবাসস্থলে তাঁবুতেও বোমা হামলা চালিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন।
অন্যদিকে, অধিকৃত পশ্চিম তীরের উত্তর রামাল্লায় এক তরুণ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা। একই সঙ্গে হেবরনের কাছে সাইর শহরের একটি পাহাড়ে তাঁবু খাটিয়ে নতুন একটি অবৈধ বসতি গড়ে তোলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ২৩ বছর বয়সী সাইফ আল-দিন কামেল আবদুল করিম মুসলাতকে সিনজিল শহরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।
আল-খালিলের (হেবরন) উত্তরের সাইর এলাকায়, স্থানীয় বাসিন্দা ও ভূমির মালিক বাসসাম আল-কাওয়াসমির বরাতে জানা যায়, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা জাবাল আল-হাদিব পাহাড়ে একটি তাঁবু স্থাপন করেছে। স্থানীয়দের মতে, এটি নতুন একটি বসতি চৌকি স্থাপনের সূচনা।
গাজার সরকারি কর্মকর্তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী সমস্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে এবং খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানি প্রবেশে বাধা দিয়েছে।
এটি ‘আধুনিক সময়ের সম্মিলিত অবরোধের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। গত তিনদিনে আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানবিক পরিস্থিতিতে খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহের ঘাটতিতে কয়েক ডজন মৃত্যুর রেকর্ড করেছি’।
অন্যদিকে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, ‘গাজায় বেঁচে থাকার মেরুদণ্ড’ জ্বালানি সংকট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা গাজায় ২১ লাখ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যখন জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন এটি অনাহারের দ্বারপ্রান্তে থাকা জনসংখ্যার ওপর অসহনীয় নতুন বোঝা চাপিয়ে দেয়। এ সংকট বেকারির নেটওয়ার্ক পরিচালনায় বাধা দেয় এবং হাসপাতাল, জল ব্যবস্থা, স্যানিটেশন নেটওয়ার্ক ও উপত্যকাজুড়ে প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে শক্তিহীন করে দেয়’।
‘জাতিসংঘের সংস্থা ও মানবিক অংশীদাররা এই মুহূর্তের জরুরিতাকে অতিরঞ্জিত করতে পারে না। জীবন রক্ষাকারী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ও ধারাবাহিকভাবে গাজায় জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে’- বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকেই গাজায় অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ)। হামলায় ইসরায়েলে অন্তত এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
হামলার জবাবে শুরু হওয়া অভিযানে একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। তবে ওই বিরতি ভেঙে ১৮ মার্চ থেকে আবারও গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই আক্রমণে গত প্রায় ছয় মাসে প্রাণ হারিয়েছেন আরও সাত হাজার ২৯৬ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ২৫ হাজার ৮৫৯ জন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে