গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত বেড়ে ৫৫,৬২৭ জন
অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি উপত্যকা গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থল অভিযান ও বিমান হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের ২৯ জনই নিহত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানেটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইএফ) এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে ত্রাণ ও খাবার নিতে গিয়ে।
বুধবার (১৮ জুন) দিনভর এসব হামলায় আহত হন আরও চার শতাধিক ফিলিস্তিনি।
এ নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গত ২০ মাসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৫৫ হাজার ৬২৭ জনে। আহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৯ হাজার ৫৪৪ জনে। নিহতদের মধ্যে ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকেই মারা গেছেন পাঁচ হাজার ৩৩৪ জন এবং আহতদের সংখ্যা অন্তত ১৭ হাজার ২০৩ জন।
অন্যদিকে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সামগ্রিক সামরিক অভিযানে নিহত ইসরায়েলি সৈন্যের সংখ্যা ৪৩২ জনে দাঁড়িয়েছে।
গাজার চিকিৎসা কর্মকর্তাদের বরাতে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা জানায়, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রতিদিনই ত্রাণপ্রার্থী ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ দুটি ঘটনা বুধবার ভোরে মধ্য গাজার নেটজারিম করিডোরের কাছে সালাহ আল-দিন স্ট্রিটে ঘটে। এই হামলায় ১৮ জন নিহত ও ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। গাজার কেন্দ্রস্থলে খান ইউনিসের অন্য একটি ত্রাণ সহায়তা কেন্দ্রে খাবার নিতে আসা মানুষের ওপরও গুলি ও গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে অন্তত ১১ জন নিহত ও শতাধিক সহায়তাপ্রার্থী আহত হন বলে জানিয়েছে গাজার সিভিল ডিফেন্স।
সংস্থাটির মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, ‘খাবার নিতে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে দখলদার বাহিনী। এ সময় একাধিক শেলও নিক্ষেপ করে তারা’।
অন্য ৪৩ জন গাজা ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশে পৃথক হামলায় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজা শহরের দক্ষিণে জেইতুন পাড়ার একটি বাড়িতে বিমান হামলায় আটজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। দক্ষিণে আল-মাওয়াসি শিবিরে বাস্তুচ্যুতদের তাঁবুতে ইসরাইলি হামলায়ও একই সংখ্যক হতাহত, অর্থাৎ দুই শিশু ও এক নারীসহ আটজন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহতের ঘটনা ঘটে।
ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানায়, অন্য এক হামলায় গাজার কেন্দ্রীয় অংশের মাজাজি শরণার্থী শিবিরে নিহত হন একই পরিবারের অন্তত ১০ জন, যাদের মধ্যে ছিলেন স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তানরাও। একই দিনে বসতবাড়ি ও বাস্তুচ্যুত মানুষের তাঁবু লক্ষ্য করে চালানো আরও তিনটি ইসরায়েলি হামলায় বাকি ১৭ ফিলিস্তিনি নিহত ও শতাধিক আহত হন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অনেকেই এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন। উদ্ধারকর্মীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না।
সর্বশেষ হামলায় হতাহত অধিকাংশ ফিলিস্তিনিকেই গাজার মধ্যাঞ্চলের আল-আওদা ও আল-আকসা হাসপাতালে এবং বাকিদের রাফার রেডক্রস হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, আহতদের অধিকাংশের অবস্থাই গুরুতর।
বিবৃতিতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে তাদের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর কাছে সহায়তা কেন্দ্রে যাওয়ার সময় বা তার আশপাশে অন্তত ৪০০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন দুই হাজার ৮০০ জনেরও বেশি।
মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ বলেন, ‘এটি সহায়তা নয়, এটি হচ্ছে দারিদ্র্যপীড়িত ও ক্ষুধার্ত জনগণকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা। এর ওপর নজর রাখছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধবিমান। সেগুলো থেকে গুলি ও শেল ছুড়ে নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের হতাহত করছে তারা’।
গাজার ‘হায়ার কমিটি ফর ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্স’ও ফিলিস্তিনিদের সতর্ক করে বলেছে, সীমান্ত ও বিতর্কিত এলাকায় খাবার নিতে যাওয়া এখন ‘মৃত্যুর ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে নিরাপদ উপায়ে সহায়তা পৌঁছে দেয়ায় জোর দিয়েছে তারা।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের নাগরিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) সহায়তা বিতরণ ব্যবস্থাকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলছে, এই কাঠামো ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের ভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করার কৌশল।
তবে, ফিলিস্তিনি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, খাবার দেয়ার কথা বলে ত্রাণকেন্দ্রে ডেকে নিয়ে গুলিবর্ষণকে ‘একটি ফাঁদ’ বলে বর্ণনা করছেন গাজার বাসিন্দা নিজেরাও। তারপরও খাবার খুঁজতে সেগুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন ক্ষুধার্ত মানুষেরা।
মে মাসের শেষ দিকে গাজার ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে খাবারের প্যাকেজ বিতরণ শুরু করে জিএইচএফ। তারা ত্রাণ বিতরণে যে নতুন মডেল অনুসরণ করছে, যার সমালোচনা করেছে জাতিসংঘও। বিশ্ব সংস্থাটি বলছে, মার্কিন উদ্যোগের জিএইচএফ পক্ষপতশূন্য বা নিরপেক্ষ নয়। ত্রাণ আনতে গিয়ে হতাহতের ঘটনাগুলোকে ‘সহায়তার নামে গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ত্রাণ চুরি করছে বলে পাল্টা অভিযোগ করে আসছে ইসরায়েল। এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান এবং ইসরায়েল ‘অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে এবং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোকে নিরপরাধ বেসামরিকদের নির্বিচার হত্যার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে’ বলে পাল্টা অভিযোগ করেছে গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাস।
এদিকে দখলদার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনুস ও নিকটবর্তী শহর আবাসান ও বানি সুহাইলার বাসিন্দাদের তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পশ্চিম দিকে তথাকথিত ‘মানবিক জোনের’ দিকে চলে যেতে বলাও অব্যাহত রেখেছে। এর কারণ হিসেবে আইডিএফ হুমকি ও হুশিয়ারি দিয়ে বলছে, তারা এই এলাকাগুলোতে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর’ বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান অব্যাহত রাখবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে আরও বেশ কয়েকটি ফিলিস্তিনি জঙ্গি গোষ্ঠীর যোদ্ধারা গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের দখলকৃত দক্ষিণ গাজা অঞ্চলে ঢুকে সমন্বিত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে এক হাজার ১৯৫ জনকে ২৫১ জনকে জিম্মি করার পর এই যুদ্ধ শুরু হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ৩৬ জন শিশুসহ ৭৩৬ জন বেসামরিক ইসরায়েলি, ৩৭৯ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং ৭৯ জন বিদেশি।
গাজার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এখনো ৫৩ জনকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ ইসরায়েলের। তাদের মধ্যে আইডিএফের নিশ্চিত করা কমপক্ষে ৩৩ জনের মৃতদেহ ও ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরও তিনজনের সুস্থতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
গত বছরের নভেম্বর মাসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। গাজায় নির্বিচারে হামলায় গণহত্যার অভিযোগেরও মুখোমুখি হয়েছে ইসরায়েল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে