Views Bangladesh Logo

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবল থেকে উদ্বাস্তু জনপদ মুক্ত করুন

দ্বাস্তু মানুষের স্থান পৃথিবীর কোথাও নেই এমনকি তার স্বদেশেও। নদী ভাঙনে, ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় পরিবারগুলো যখন অন্য কোনো জায়গায় বসতি স্থাপন করে সেখান থেকেও তাদের উচ্ছেদ করা হয় রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার বাস্তুচ্যুত মানুষের অন্যতম বৃহৎ আশ্রয়স্থল বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা প্রাচীন সন্দ্বীপের প্রান্তিক ইউনিয়ন উড়িরচর; কিন্তু এখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে তাদের সেই জনপদ থেকেও উদ্বাস্তু হতে হচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৮ সালের দিকে সন্দ্বীপ থেকে ২৫টি ভূমিহারা পরিবার প্রথম উড়িরচরে বসতি স্থাপন করে। এরপরের দুই-তিন বছর শত শত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে এখানে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ১৯৮৫ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও সন্দ্বীপের ভূমিহীন মানুষ দ্রুত ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ২০১০ সালের দিকে মেঘনা অববাহিকার ভোলা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর বিভিন্ন ছোট-বড় দ্বীপের ভিটেহারা মানুষ এসে এখানে নতুন করে জীবন শুরু করেন। বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার পরিবার এই দ্বীপে বসবাস করছে, যাদের আগের ঠিকানা সমুদ্রের বুকে বিলীন হয়ে গেছে; কিন্তু এখন ভূমি-বাণিজ্যের ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বরাদ্দযোগ্য জমি অস্থানীয় বিত্তশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ভূমি-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ।

প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেলেও উড়িরচরের এই ভূমিহীন মানুষরা এখনো তাদের ভূমির অধিকার পাননি। উল্টো তারা এখন ভূমি হারানোর ঝুঁকিতে। সরকারের চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রোগ্রাম (সিডিএসপি) উদ্বাস্তুদের ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানে কাজ করেছে। ফলে দেরিতে হলেও ভূমির মালিকানা নিয়ে আশাবাদী হয়েছিলেন উড়িরচরের বাসিন্দারা; কিন্তু প্রকল্পটি চরবাসীর জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বরং নিপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ইউনিয়নটিতে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাও নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। ২২ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নেই এখানে। নেই কোনো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ভবন। পরিষদের সব কার্যক্রম চলে দোকানপাটে। ইউনিয়নের একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ব্যবহার হচ্ছে পুলিশ ফাঁড়ি হিসেবে। একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিও চলছে মাত্র তিনজন শিক্ষক দিয়ে।

উড়িরচরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে তাদের একই জায়গা বারবার কিনতে হয়েছে। ২০০৫ সালের দিকে উড়িরচরের উত্তর-পশ্চিমাংশে দ্রুত চর জেগে ওঠে। ২০০৮ সালের দিকে লক্ষ্মীপুরের রামগতির দুই জলদস্যু নাছির কেরানী ও নিজাম ডাকাত সেসব জায়গা সেখানকার বাস্তুচ্যুত মানুষের কাছে বিক্রি শুরু করে। ২০১০ সালে উড়িরচরের শীর্ষ দস্যু জাসেদ ওরফে জাসু বন উজাড় করে ভূমিহীনদের কাছে জমি বিক্রির মহোৎসবের আয়োজন করে। জাসু প্রতি দাগ (দুই একর) জায়গা দু-তিন হাজার টাকায় বিক্রি করত। ফলে উড়িরচরের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় ভোলা, হাতিয়া ও রামগতির নিকটবর্তী বিভিন্ন দ্বীপের ভিটেমাটি হারানো মানুষদের বসবাস দেখা যায়, যারা স্থানীয়ভাবে ‘ভূমিহীন’ নামে পরিচিত।

প্রশ্ন হচ্ছে, স্বদেশের ভূমিহীন এসব অসহায় মানুষের প্রতি সরকার কেন এত অবহেলা? ভূমিহীনদের মাথাগোঁজার শেষ ঠাঁইটুকুও কেন কেড়ে নিচ্ছেন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা? ভূমি দখলে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে প্রশাসনেরও যোগসূত্র রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। ভূমির রাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আবদুল বায়েস মনে করেন, উড়িরচরে গৃহহীন মানুষের এই যে সমস্যা তা বাংলাদেশের প্রায় সব চরাঞ্চলের সমস্যা থেকে আলাদা নয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমন যে এসব সমস্যা জিইয়ে থাকে দশকের পর দশক ধরে। এর অন্যতম কারণ, এ সমস্যায় নিমজ্জিত মানুষরা ক্ষমতাকাঠামোর একেবারে নিম্নস্তরের এবং তাদের কণ্ঠ প্রায় শোনাই যায় না। সামাজিক বিভিন্ন নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করে; কিন্তু এসব মানুষের কাছে সম্পদ হস্তান্তর করতে রাষ্ট্র রাজি নয়। যত দিন এমন চলবে, তত দিন এসব মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। উড়িরচরের মতো চরাঞ্চলের মানুষের ভূমির জটিলতা দূর করতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য অবশ্যই সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। চর অর্থনীতি নামে সব চরাঞ্চলের জন্য আলাদা কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।

আমরাও মনে করি এসব প্রান্তিক মানুষের আর্তনাদ সরকারকে শুনতে হবে। স্বদেশের মানুষের এমন বাস্তুহানি কোনোভাবেই একটা সভ্য রাষ্ট্রের পরিচয় হতে পারে না। উড়িরচরের মতো চরাঞ্চলের সমস্ত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে, তাদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে অবশ্যই জরুরি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মুক্ত করে তাদের এক নিশ্চিত-নিরাপদ জীবন দিতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ