আফসান চৌধুরীর কাছে শোনা মুক্তিযুদ্ধের টুকরো গল্প
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সামাজিক বাস্তবতা বুঝতে হলে আফসান চৌধুরীর মুখোমুখি বসে কিছু কথা না শুনলেই না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার গবেষণা থাকলেও, তিনি মুক্তিযুদ্ধকে কখনোই সেই রাষ্ট্রীয় গবেষকের চোখ দিয়ে দেখেননি। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছেন একজন সামাজিক মানুষের চোখ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে একটি জনযুদ্ধ, যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় লিপিবদ্ধ ইতিহাসের চেয়ে মানুষের টুকরো গল্পেই বরং উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন বাস্তবতা।
যুদ্ধে নারীর যে অবদান আর অবস্থান, সেই সত্য সম্পূর্ণভাবে কখনোই উদ্ঘাটিত হয়নি। আমাদের সাহিত্য আর চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বলতে একটি বিষয় বড় করে উঠে আসে, সেটি হলো নারী বীরাঙ্গনা, নারী ধর্ষিতা। অথচ এই জনযুদ্ধ যেন বাংলাদেশের প্রতিটি নারী আলাদা আলাদা যুদ্ধের উপাখ্যান। সে উপাখ্যানের বিস্তৃতি অসীম। এই অসীমের মাঝ থেকেই তার মুখে শোনা তিনটি টুকরো গল্প নিয়ে আমার আজকের লেখা।
পাহারায় বসে থাকা অতন্দ্র বিধবা
গ্রামের একপ্রান্তে সেই বিধবা বৃদ্ধার বসবাস। সন্তানহীন বৃদ্ধার সংসার চলে মুরগির ডিম বিক্রি করে। বাড়িতে মুরগি পালন করে, সেই মুরগির ডিম বেচে কোনোরকমে দুবেলার ভাত জোগাড় করে সে। এর মধ্যেই দেশে এলো যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ। একদিন ছয়-সাতজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নিল। কয়েকদিন অভুক্ত থেকে আর পায়ে হেঁটে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত তারা। এতগুলো পেট, তার বিপরীতে বৃদ্ধার তো কোনো বাড়তি ব্যবস্থা নেই। বাড়িতে আছেই মোটা চাল আর কিছু ডিম দেয়া মুরগি। বৃদ্ধা এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না। মুরগিগুলো কেটেই অন্ন তুলে দিল ক্ষুধার্ত যোদ্ধাদের মুখে। রাতে নির্ঘুম থেকে দরজার সামনে বসে পাহারা দিল তাদের।
এরপর, মুক্তিযোদ্ধারা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে গেল নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে। মাঝে অনেক দিন পার হয়ে গেল। একদিন বৃদ্ধার বাড়ির কাছ দিয়েই যাচ্ছিল আরেকটি যোদ্ধার দল। তাদের মধ্যে দু-একজন ছিল যারা সেদিন এখানে অন্ন পেয়েছিল, পেয়েছিল ক্লান্তি দূর করার জন্য নিশ্চিন্ত ঘুম। তাদের একবার মনে হলো, বৃদ্ধার একটু খোঁজ নেয়া দরকার। তারা যখন বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো, তখন সেখানে সুনসান নীরবতা। ঘরের মধ্যে পড়ে আছে বৃদ্ধার মৃতদেহ। কতদিন ধরে সে মরে পড়ে আছে, শেষ পুঁজি মুরগিগুলো হারিয়ে কি অনাহারে মারা গেল, নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার অপরাধে পাকিস্তানি আর্মির নির্যাতনে জীবন দিল, সে খবর কেউ জানে না।
গল্প শেষ করে আফসান চৌধুরী প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, এখন এই বিধবা, সন্তান হারানো বৃদ্ধা মাকে আপনি কী উপাধি দেবেন? ইতিহাসে কোথায় তাকে স্থান দিলেন? উনি আবার বললেন, 'এসব তালিকা করা সব রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় গবেষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নারীদের, বিশেষ করে বিধবা নারীদের অবদান তুলে ধরা যায়নি। গ্রামে-গঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে যে সাহস নিয়ে বিধবা নারীরা দাঁড়িয়েছিল, সে সাহস অন্যরা পেত না। এর কারণ, স্বামী না থাকায় তারা নিজেরাই এসব সিদ্ধান্ত নিত।
কচুরিপানা কিশোরী
১৩-১৪ বছরের নাম না জানা কিশোরী, সাথে আছে ছোট ছোট সন্তানসহ অনেক নারী। পরিবারের অন্যান্যদের সাথে তারা জড়ো হয়েছে নদীর পাড়ে। লক্ষ্য কোনোরকমে নদী পার হয়ে ভারত সীমান্তে ঢুকে যাওয়া; কিন্তু সেই যাওয়াটা খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। প্রথমত, তাদের বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো নৌকা নেই। তাছাড়া নৌকায় যাওয়াটা খুবই অনিরাপদ, কখন পাকিস্তানি হানাদারের গানবোট এসে হানা দেবে, শিশুদের হত্যা করবে, নারীদের তুলে নিয়ে যাবে, তার কোনো হিসাব নেই।
গোপনে এবং সাঁতরে নদী পার হতে হবে। ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তা সম্ভব না, তাই মানুষ একটা কৌশল করেছে। কচুরিপানা জড়ো করে একসঙ্গে বেঁধে একটি বড় ভেলার মতো করেছে। সেটা নদীতে ছেড়ে দিয়ে সেটার চারপাশের দড়ি ধরে সবাই নিজেকে টিকিয়ে রাখবে। সবাই যখন মাঝ নদীতে তখন সেই কিশোরীর পাশে ভেসে থাকা সন্তান কোলে এক মা ভীষণ ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করলেন। তারা যেদিকে দড়ি ধরে ভেসেছিল, সেদিকটায় মানুষের অতিরিক্ত চাপে ডুবুডুবু অবস্থা। সেই মা চিন্তায় পড়ে গেলেন সন্তান কোলে তিনি ভেসে থাকতে পারবেন কি না।
প্রাণভয়ে চিৎকার করছেন নারীটি, এদিকে অন্যদের ভয় এই চিৎকারে পাকিস্তানি হানাদার না চলে আসে। অবস্থা বেগতিক বুঝে সবার জীবনের কথা চিন্তা করে কিশোরীটি ভেলার দড়ি ছেড়ে দিল আর মুহূর্তেই তলিয়ে গেল গভীর জলের বুকে। সন্তান কোলে সেই মা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আমিও নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে আফসান চৌধুরী অস্থির হয়ে দুই হাত নাড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, 'এটা কী? এটাকে আসলে কী বলব, আত্মহত্যা? মানে কী মনে করে মেয়েটি এই কাজ করল? এই মেয়েটি কি শহীদ না?'
যুদ্ধশিশু
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিন বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে রাঙা আপার তিনজনের ছোট সংসার। মে মাসের কোনো এক সকালে রাঙা আপার কাছে খবর এলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার দায়ে তার স্বামীকে পাকিস্তানি আর্মি ধরে নিয়ে গেছে। এক অফিসার এসে জানাল, তার কথামতো চললে, নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করলে, ভদ্রলোককে বাঁচিয়ে রাখা হবে। এরপর দীর্ঘদিন রাঙা আপা এসব অত্যাচার মুখ বুঝে মেনে নিয়ে চলতে থাকলেন। বাড়ির পরিবেশ হয়ে উঠল নরকের মতো। একে তো বাবা হঠাৎ করেই নেই, তারপর মায়ের ওপরে এরকম নির্যাতন। শিশুটির মানসিক অবস্থা নিয়ে সেসময় কারও সেভাবে ভাবার হয়ত অবকাশ ছিল না। এর মধ্যে নভেম্বরে এসে রাঙা আপা জানতে পারলেন, যুদ্ধে সেই অনাচারী আর্মি অফিসার মারা গেছে আর তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে সেই মে মাসেই। ততদিনে রাঙা আপার স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বা দেশে থাকার সব পথ বন্ধ। মেয়েকে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে রেখে চিরতরে নিরুদ্দেশ হলেন রাঙা আপা।
গল্প শেষ করে আফসান চৌধুরী বললেন, 'যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক দিন পর সেই বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলো আমার। আমাদের বাড়িতে সে ছিল একবেলা। কি উদ্ভ্রান্ত আর অস্থির মেয়েটি! এত ছোট মেয়ে, বাবা নেই, একদিন দেখল মাও নেই। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের মধ্যে পড়ে মেয়েটির মানসিক অবস্থা কেমন ছিল ভাবা যায়! এই যে আমরা যুদ্ধশিশু যুদ্ধশিশু বলে কত কথা বলি। এই শিশুটিকে তবে আমরা কী বলব? সে কি যুদ্ধশিশু না? অথবা তাদের মতো শিশুরা তবে কি স্বাভাবিক শিশু?
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে