Views Bangladesh Logo

জোর করে চুল-দাড়ি কেটে দেয়ার হোতা ও ভুক্তভোগী কারা, আইন কী বলে

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একটি অস্বস্তিকর প্রবণতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনা চলছে। দেখা যাচ্ছে, মাজারের আঙিনায় অবস্থান করা কিংবা রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করা বয়স্ক ব্যক্তিদের হঠাৎ করেই ধরে জোরপূর্বক চুল ও দাড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। এসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সর্বস্তরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

ভাইরাল ভিডিওর ভুক্তভোগী কারা

ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মে এরকম একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ভিক্ষাবৃত্তি করে চলা, মাজার বা শ্মশানে বসবাস করা বা মরমি ধারার জীবনযাপন করা একাধিক ব্যক্তিকে কয়েকজন যুবক জোর করে ধরে তাদের দাড়ি-চুল বা জটা কেটে দিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ভুক্তভোগীকে হুমকির দিয়ে বা হাসি-ঠাট্টার ভঙ্গিতে এসব কাজ করা হচ্ছে।

স্থানীয়দের মতে, এসব ভুক্তভোগী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে মাজারে মাজারে থাকেন বা রাস্তায় অবস্থান করেন। তাদের বেশিরভাগই সংসারহীন। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা ধর্মীয় দীক্ষা বা সুফি দর্শনের অনুসারী হিসেবে ‘ফকির’ বা ‘দরবেশ’ জীবন বেছে নিয়েছেন। সুফীবাদের ঐতিহ্যে এমন জীবনযাপনের নজির নতুন নয়। ইতিহাসে দেখা যায়, উপমহাদেশের বহু সুফি সাধক সাধারণ জীবনধারা গ্রহণ করতেন, সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে মিশে থাকতেন।

এরকম ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রকাশ্যে জোর করে এক বৃদ্ধের চুল ও চুলের জট কেটে দেওয়া হচ্ছে। টুপি-পাঞ্জাবি পরা তিন ব্যক্তি বাজারে বাউল ফকিরের মতো দেখতে ব্যক্তির চুল কেটে দেওয়ার সময় বয়স্ক এ মানুষটি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। এক পর্যায়ে দৌড়েও পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ, তুই দেহিস।’

জানা যায়, এই ভুক্তভোগী হালিম উদ্দিন আকন্দ (৭০) ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজার এলাকার কোদালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয়রা তাকে হালিম ফকির হিসেবেই চেনেন। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত নন। তিনি হজরত শাহজালাল (র.) ও শাহ পরানের (র.) ভক্ত এবং দীর্ঘ ৩৪ বছর মাথায় জট ছিল তার।গত কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজারে হঠাৎ করেই একদল লোক এসে তাকে দৌড়ে ধরে জোরপূর্বক মাথার জট, দাড়ি ও চুল কেটে দেয়। এই ঘটনার সময় আশপাশের মানুষ কোন বাধা দেয়নি।

হালিম উদ্দিন জানান, হযরত শাহজালালের মাজারে যাওয়ার পর থেকে তিনি কোনোদিন চুল কাটেননি। তার চুলের বয়স ছিল আনুমানিক ৩০ বছর। হঠাৎ করেই এই ব্যক্তিরা জোর করে চুল কেটে দেওয়ার সময় তিনি জ্ঞান হারান। এই ঘটনার প্রভাবে বর্তমানে তিনি ভীতির মধ্যে থাকেন, বিষণ্ন থাকেন। হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। জোর করে চুল, দাড়ি এবং জটা কেটে দেয়া আরেক ব্যক্তির বিষয়ে জানা যায়, তিনিও ভবঘুরে বা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন না। তিনি শ্মশানে মরদেহ পোড়াতেন এবং বহু বছর যাবৎ জটা নিয়েই ঘুরছেন।

সর্বস্তরে ক্ষোভ, তীব্র সমালোচনা

এরকম কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে গেলে নেটিজেনদের মধ্যে তৈরি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। এসব ঘটনায় মানবাধিকারকর্মী ও সামাজিকভাবে সচেতন মানুষজন বলছেন, এগুলো মানব মর্যাদার প্রতি চরম আঘাত।ফকির আবদুস সাত্তার, কুষ্টিয়ার একজন লোকশিল্পী এবং বাউল গানের শিল্পী, যিনি কুষ্টিয়ার লাহিনী অঞ্চলে বসবাস করেন। তিনি মূলত বাউল গান ও ভাব গান পরিবেশন করেন, তিনি এই বিষয়ে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, যার যার মনের বিষয়ের উপর কাররই জোর প্রয়োগ করা উচিত নয়। মত তো আর মানুষের সব গদবাঁধা নিয়মের অধীনে চলে না। তাই যে চুল-দাড়ি বড় করছে তার মনের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ কারোরই উচিত নয়। রাষ্ট্র যদি মানবিক হয় তবে সকলের মত এবং পথ তাকে তার মতই চলতে দেয়া দরকার বলেও মনে করেন ফকির আবদুস সাত্তার।

এদিকে এসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে দায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক বলছে, রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননা ও বেআইনি আচরণের শিকার না হন।বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা জানায় আসক। আসক জানায়, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩২ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং অনুচ্ছেদ ৩৫ কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে। প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, বরং তার মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।

চুল-দাড়ি কাটার হোতা কারা?
এসব ঘটনার সঙ্গে অন্তত তিনজন ব্যক্তি জড়িত। তারা হলেন মো. আফসার আহমেদ, মুফতি সোহরাব ও মো বেলাল মিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়, তারা নিয়মিত গৃহহীন ও পরিবারহীন মানুষের চুল-দাড়ি কাটার ভিডিও তৈরি করেন এবং ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করেন। মানুষদের জন্য স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও মৌলিক সহায়তা” দেওয়ার নামে প্রচার করা হয়। “Human Service Bangladesh” নামের পেইজ থেকে আলোচিত হালিম উদ্দিনের হেনস্তার ভিডিওটি ছড়ানো হয়েছে। জানা যায়, এর আগে এই পেইজটি অন্য নামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভিডিও তৈরি করত। তখন এটির নামও ছিল ভিন্ন। এই পেইজে অন্তত চারটি এরকম ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে এসব ব্যক্তিদের গায়ে ‘Human Service Bangladesh’ লোগো সংবলিত ভেস্ট থাকে।

এই দলের মূল হোতা মুফতি সোহরা। সম্প্রতি বাংলাফ্যাক্টকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে সে স্বীকার করে যে ভিডিও নির্মাণ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পরিচালনার ব্যাপারে তাঁদের খুব বেশি অভিজ্ঞতা নেই।তবে উদ্যোগ নেয়ার পর সে বুঝতে পারে যে এর মাধ্যমে অর্থ আয় করা সম্ভব। এরপর সে BD TheBest পেইজের মালিক মো আফসারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি পরে পেইজের নাম পরিবর্তন করেন। পেইজ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগে মো আফসার পার্ক, সিনেমা হলসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে ভিডিও কনটেন্ট বানাতো। এই পেইজের আরেকজন সদস্য একজন সিএনজি চালক বলে জানা যায়। ভিডিও আপলোডকারীরা দাবি করছেন- আমরা তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছি, যাতে তারা একটু ভালোভাবে থাকতে পারেন।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ নাকি অমানবিক আচরণ?

অর্থ উপার্জনের জন্য একজন নিরীহ বা দুর্বল মানুষকে ব্যবহার করা মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। প্রশ্ন উঠেছে: ভুক্তভোগীর ইচ্ছা ও সম্মতি ছাড়া এমন কাজ কতটা ন্যায়সংগত? এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “যারা সমাজের প্রান্তিক, মানসিকভাবে দুর্বল বা সংসারহীন, তারা সবচেয়ে বেশি ভিকটিম হন এ ধরনের আচরণের। সুফি দর্শনের অনুসারী হোন বা মানসিক রোগী, তাদেরও নাগরিক অধিকার আছে। দাড়ি-চুল কেটে দেওয়ার নামে অপমান করা নিছক ক্ষমতার প্রদর্শন।


মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটাল এর সহযোগী অধ্যাপক, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসক ডা. চিরঞ্জীব বিশ্বাস বলেন, যারা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে চুল-দাড়ি বড় করে রাখছেন সেখানে তাদেরকে অন্যভাবে কিছু বলার নেই। সরা পৃথিবীব্যাপী এই ধরনের প্রচলন আছে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। তবে যদি কেউ বা কোন গ্রুপ চুল-দাড়ি বড় করে রাস্তায় ঘুরে এবং এর সাথে মাদকের কোন ধরনের সম্পর্ক থাকে সেক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতেই পারে। সব মানুষের প্রতি আমাদের সবার যত্নশীল হওয়া উচিত, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য ‘কনটেন্ট’ বানানো নয়।

সামাজিক ও ধর্মীয় দিক
রাস্তাঘাটে সুবিধা-বঞ্চিত, ভবঘুরে, বা গৃহহীনদেরকে চুলদাড়ি কাটার বা তাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবার সেবা প্রদান করার সংস্কৃতি উন্নত-সভ্য-বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে উন্নত-সভ্য-বিশ্বে এই ধরনের সেবা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে এই ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের আগে কয়েকটা বিষয় নিশ্চিত করতে হয়।প্রথমত, রাস্তাঘাটে বা কোনো উন্মুক্ত স্থানে চুল কাটার জন্য অস্থায়ী সেলুন বসাতে হলে আয়োজকে অবশ্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, কেউ নিজের ইচ্ছায় চুলদাড়ি কাটার সেবা নিতে আসলে শুধু তাকেই সেই সেবা প্রদান করা যাবে। কাউকে ধরে এনে জোরজবরদস্তি করে তার চুলদাড়ি কেটে দেয়া যাবে না।

তৃতীয়ত, সেবা প্রদানকারীকে হতে হবে চুলদাড়ি কাটার বিষয়ে দক্ষ, কাজটা করতে হবে পেশাদারিত্ব এবং স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে। সেবা গ্রহণকারীর চুলদাড়ি কাটতে হবে তার নিজের পছন্দমতো, মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে নয়। উপরের এই তিনটি বিষয় এ কারণে জরুরি যে, এগুলো মেনে চলার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রের আইনের প্রতি, সুবিধা-বঞ্চিত-ভবঘুরে বা গৃহহীন লোকজনের প্রতি, এবং মানুষের অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।

এদিকে, ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে বড় চুল রাখার গুরুত্ব রয়েছে। সুফীবাদের অনুসারীরা দীর্ঘ চুল-দাড়িকে আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসেবে দেখেন। এ বিষয়ে ইসলামী চিন্তাবিদ হাফেজ মাওলানা শওকত আলী বলেন, ফকির-দরবেশদের জীবনযাপন অনেক সময় সাধারণ মানুষের কাছে ভিন্ন রকম মনে হয়। কিন্তু কারো ধর্মীয় পরিচয় ও সাধনার চিহ্নকে উপহাস করা বা জোরপূর্বক পরিবর্তন করা ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধী। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মুহাদ্দিস, গবেষণা বিভাগ, ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান বলেন, চুল-দাড়ি যদি কেউ নফল হিসেবে রাখা তা তো যে কেউ চাইলেই কেটে ফেলতে পারে না। এটা আইন এবং সমাজ সব দিক থেকেই অনুচিক। তবে কতটুকু চুল-দাড়ি বড় করে রাখা যাবে তারও একটা বিধান রয়েছে।

আইন কী বলে
আইনবিদদের মতে, কারও অনুমতি ছাড়া তার দাড়ি-চুল কেটে দেওয়া শারীরিক আঘাত এবং মানসিক নির্যাতনের শামিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পক্ষ থেকে ভিউজ বাংলাদেশকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ, উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন এমন ঘটনা ঢাকা শহরের মধ্যে তাদের চোখে পড়েনি। তবে বিষটিকে তিনি নিন্দনীয় হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, কারও অনুমতি ছাড়া এমন কাজ অবশ্যই আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। কেউ অভিযোগ করলে তার বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ