Views Bangladesh Logo

ফ্ল্যাট কালচার সমস্যামুক্ত নয়

M A  Khaleque

এম এ খালেক

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে আবাসন সুবিধা নিশ্চিতকরণ অন্যতম। এই ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থান হচ্ছে আবশ্যিক মৌলিক চাহিদা বা অধিকার। অর্থাৎ এই তিনটি অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। শিক্ষা ছাড়াও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। যদিও সেই বাঁচা হবে পশুতুল্য। তারপরও মানুষ শিক্ষা গ্রহণ ব্যতীত টিকে থাকতে পারে; কিন্তু অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থান নিশ্চিত করা না গেলে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই একজন মানুষ অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা পূরণের পরই নিরাপদ বাসস্থানের বিষয়টি বিবেচনা করে থাকে। এক সময় মানুষ নিজের বাসস্থান নিজেই তৈরি করতো; কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। মানুষ এখন ফ্ল্যাট কালচারের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে।

শহরের মানুষ তো এখন ফ্ল্যাটে বসবাস করার কোনো বিকল্প খুঁজে পাচ্ছে না। নিজে জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে নানা ঝামেলা রয়েছে। বাড়ি নির্মাণ করতে গেলেই চাঁদাবাজরা ঘিরে ধরে। চাঁদা দিতে না চাওয়ার কারণে অনেকে সময় সন্ত্রাসীদের হাতে বাড়ি নির্মাতার প্রাণ দিতে হয়েছে। মূলত এসব কারণেই যাদের জমি আছে তারা নিজেরা বাড়ি নির্মাণ করতে উদ্যোগী না হয়ে ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে ভবন নির্মাণ করিয়ে নিচ্ছেন। ভবন নির্মাণ শেষ হলে ডেভেলপার কোম্পানি এবং জমির মালিকরা সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক নির্দিষ্ট হারে ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যান। যাদের জমি আছে কিন্তু কোনো ধরনের ঝামেলায় যেতে চান না তারা ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণকে সবচেয়ে সহজ উপায় বা পন্থা হিসেবে মনে করছেন। ডেভেলপার কোম্পানি ভবন নির্মাণের সমুদয় ব্যয় নির্বাহ করেন। তার বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে ফ্ল্যাটের মালিক হন। এই ফ্ল্যাট তিনি নিজে ব্যবহার করতে পারেন। আবার বিক্রি বা ভাড়া দিতে পারেন। আর জমির মালিক তার জমির বিনিময়ে নির্দিষ্টসংখ্যক ফ্ল্যাট পেয়ে থাকেন।

জমির মালিক এবং ডেভেলপার কোম্পানির মধ্যে অফেরতযোগ্য আমমোক্তারনামা স্বাক্ষরিত হবার পর জমির পূর্বতন মালিক তার মালিকানা স্বত্ব হারিয়ে ফেলেন। ডেভেলপার কোম্পানি যদি স্বাক্ষরিত জমির মূল মালিকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অফেরতযোগ্য আমমোক্তারনামার চুক্তির কোনো শর্তের মারাত্মক লঙ্ঘন না করেন তাহলে তিনি আর কখনোই পুরো জমির মালিকানা ফিরে পাবেন না। এমনকি যে কোনো আদালতে জমির পূর্বতন মালিক তার জমির মালিকানা স্বত্ব দাবি করলে তা অগ্রাহ্য হবে।

আমাদের দেশে ফ্ল্যাট কালচার শুরু হয় মূলত বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। এরপর তা দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। এক সময় শুধু রাজধানীতে ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করার প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যেত; কিন্তু এখন তা জেলা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। জেলা শহরেও এখন অনেকেই নিজে বাড়ি নির্মাণ না করে ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণ করছেন। এক সময় ফ্ল্যাট ক্রয়ের সময় শুধু ফ্ল্যাট ক্রেতার নামে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হতো। এতে সমস্যা দেখা দেয়। যদি জমিসহ ফ্ল্যাট ক্রয় না করা হয় বা রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া না হয় তাহলে ৯৯ বছর পর জমির মালিকানা ডেভেলপার কোম্পানির হাতে চলে যাবে। কারণ বর্তমান প্রচলিত ভূমি আইনে একটি ভবন বা ফ্ল্যাটের আয়ুষ্কাল ৯৯ বছর। এই সময়ের পর ভবনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যায়। তাই এখন প্রতিটি ফ্ল্যাটের সঙ্গে আনুপাতিক হারে জমিও রেজিস্ট্রেশন করে দেয়া হয়। তবে রেজিস্ট্রেশনকৃত জমি নির্দিষ্ট করা থাকে না। অর্থাৎ দলিলে লেখা থাকে এত বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং অচিহ্নিত ও অবিভাজ্য এত অজুতাংশ জমি।

এভাবে লেখার কারণে ভবিষ্যতে ফ্ল্যাট ক্রেতাকে বঞ্চিত করা যাবে না। ভবিষ্যতে বর্তমান ফ্ল্যাট ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাট মালিককে নির্দিষ্ট আকারের ফ্ল্যাট এবং আনুপাতিক হারে জমির মালিকানা দিতে হবে। এই নিয়ম ফ্ল্যাট ক্রেতার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য হয় তেমনি জমির প্রাক্তন মালিকের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। জমির প্রাক্তন মালিক যেহেতু তার জমির মালিকানা স্বত্ব হারাচ্ছেন তাই তাকে নির্দিষ্টসংখ্যক ফ্ল্যাট দেয়া হয় যা আগে থেকেই ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে উল্লেখিত থাকে। জমির প্রাক্তন মালিক এবং ফ্ল্যাট ক্রেতা উভয়েই ফ্ল্যাট এবং জমির মালিক। একজন উত্তরাধিকার সূত্রে জমি ও ফ্ল্যাট লাভ করেন। আর অন্যজন ক্রয়সূত্রে জমি ও ফ্ল্যাটের মালিক হন। বিষয়টি অনেকটা এই রকম- ডেভেলপার কোম্পানি জমির পূর্বতন মালিককে ‘গরু মেরে জুতা দান’ করেন। আর ক্রেতা অর্থের বিনিময়ে জুতা কিনে নেন। উভয়েই জুতার মালিক।

ব্যক্তি মালিকানায় ভবন বা ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলে সেখানে ভবনের সৌকর্য অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষা করা সম্ভব হয় না। মালিক সাধারণত অর্থ সাশ্রয় করার জন্য চেষ্টা করেন। আর ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ভবন এবং ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলে তারা সবসময়ই দৃষ্টিনন্দন ভবন তৈরির চেষ্টা করে, যাতে ভবিষ্যতে কোম্পানির সুনাম বৃদ্ধি পায়। ফ্ল্যাট বাসায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমাগম ঘটে। ফলে এখানে চমৎকার একটি সোসাইটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। ফ্ল্যাটে বসবাসকারী সবাই যদি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান এবং রুচিশীল হন তাহলে প্রতিটি ফ্ল্যাট বাড়ি একটি ফুলের বাগানে পরিণত হতে পারে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানা সমস্যা ফ্ল্যাটবাসীদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাদ প্রচলিত আছে- কয়েকটি বিষয়ে অত্যন্ত ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেবার সময় পাত্র-পাত্রীর আর্থিক অবস্থা, সামাজিক মর্যাদা এবং কৌলিন্য। আর জমি বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে জমির দলিলি স্বত্ব, দখলি স্বত্ব এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভালোভাবে দেখে নিতে হয়। ফ্ল্যাট বাড়িতে ফ্ল্যাট ক্রয়ের সময় আশপাশের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে খুব ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিতে হয়। যদি প্রতিবেশী ভালো না হয় তাহলে সারা জীবন পস্তাতে হবে। আর প্রতিবেশী যদি ভালো হয় তাহলে তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু থাকতে পারে না। যার হাত এবং মুখ থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয় তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ হতে পারে না।

মানুষ পেট ভরে খেতে পাক আর নাই পাক দিন শেষে বাড়িতে ফিরে স্বস্তিতে ঘুমাতে চায়; কিন্তু প্রতিবেশী যদি ভালো এবং উদার মনের না হয় তাহলে আপনার দিনের পরিশ্রম এবং রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেতে পারে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। যত শক্তিশালী ব্যক্তিই হোন না কেন তাকে একদিন না একদিন মরতেই হবে। মৃত্যু এমনই এক বাস্তবতা যা সবাইকে গ্রহণ করতে হবে; কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে নিশ্চিত জেনেও কেউ মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে চায় না। মানুষ মাত্রই মরণশীল। শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) প্রতিবেশীদের ‘হক’ আদায়ের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। রাতেরবেলা খাবার খেতে বসার আগে প্রতিবেশী চল্লিশটি বাড়িতে খোঁজ নেবার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে ব্যক্তি পেট পুরে আহার করে সে কখনোই প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি হতে পারেন না। নবীজি (সা.) একদিন উপস্থিতি সাহাবাদের নিকট প্রতিবেশীর হক বর্ণনা করছিলেন। তিনি এমনভাবে প্রতিবেশীর হকের কথা বলছিলেন উপস্থিত সাহাবিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা ভেবেছিলেন, নবীজি (সা.) বোধ হয় প্রতিবেশীদের সম্পদের উত্তরাধিকার ঘোষণা করবেন।

যারা ফ্ল্যাট বাড়িতে বসবার করেন প্রতিবেশীদের হক সম্পর্কে তাদের অধিক সচেতন থাকা উচিত। ফ্ল্যাটে বসবাসকালীন সময় এমন কোনো কাজ করা যাবে না যা প্রতিবেশীদের কষ্টের কারণ হতে পারে। ফ্ল্যাটে বসরবাসকারীদের মধ্যে কিছু মানুষ থাকেন যারা অন্যকে কষ্ট দিয়ে সুখ অনুভব করেন। বিশেষ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাবেক ভূমি মালিকদের মধ্যে এক ধরনের অহমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা এমন ভাব দেখান যেন তারা এখনো পুরো জমির মালিক এবং যারা ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন তারা বহিরাগত বা তাদের করুণার পাত্র। এরা নানাভাবে সমস্যা সৃষ্টি করেন। কোনো কোনো সময় কমন সার্ভিস চার্জ প্রদান না করে আটকে রাখেন। এতে ইউটিলিটি চার্জ প্রদানে সমস্যা হয়। এরা নিজেদের ল্যান্ড লর্ড বলে মনে করেন। অথচ বাংলাদেশের ভূমি আইনে ল্যান্ড লর্ড বলে কোনো শব্দ নেই। গ্রহণযোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক এরা অ্যাপার্টমেন্ট মালিক সমিতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে ধরে থাকতে চান।

আমি একবার নিকটবর্তী একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের সভায় উপস্থিত ছিলাম। যিনি প্রাক্তন ল্যান্ডওনার বিল্ডিংয়ে তার ভাগে পড়েছে ২৫টি ফ্ল্যাট। তিনি দাবি করেন, সমিতিতে তার ভোটের সংখ্যা হবে ২৫টি। প্রতিটি ফ্ল্যাটের বিপরীতে একটি করে ভোট। আমি তাকে বললাম, ভোট কখনোই সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। ভোট নির্ধারিত সম্পদের মালিক কতজন তার ভিত্তিতে। তার নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি ফ্ল্যাট যেহেতু তার নিজের নামে নিবন্ধিত তাই তার ভোট হবে একটি। এই ২৫টি ফ্ল্যাটের মালিকানা যদি একাধিক ব্যক্তির নামে হতো, এমনকি ২৫ ব্যক্তি এসব ফ্ল্যাটের মালিক হতেন তাহলে তাদের ভোটের সংখ্যা ২৫ হতে পারত। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই আমার যুক্তি মানতে নারাজ। আমি তাকে বলার চেষ্টা করি, রাজধানীতে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যাদের একাধিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে তার অর্থ এই নয় যে তিনি জাতীয় অথবা স্থানীয় নির্বাচনে বাড়ি বা ফ্ল্যাট প্রতি ভোটের মালিক হবেন; কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তার অবস্থান থেকে সরে সম্মত হচ্ছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়নি।

যারা ফ্ল্যাট মালিক সমিতির নির্বাহী কমিটির সম্পাদকীয় পদ হোল্ড করবেন তাদের সততা এবং আমানতদারির ওপর ফ্ল্যাট মালিকদের ভালো থাকা না থাকার বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে। মানুষের ‘হক’ নষ্ট করা বা আমানতের খেয়ানত করা অত্যন্ত গর্হিত অন্যায় কাজ; কিন্তু যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন তাদের নিকট মানুষের হকের কোনো মূল্য নেই। ফলে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপকরণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়।

ফ্ল্যাটে বসবাস করা অত্যন্ত আনন্দদায়ক হতে পারে যদি বসবাসরত প্রতিটি মানুষ ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করেন। কারও ক্ষতি করার চেষ্টা না করেন। কথায় বলে, রক্তের বাঁধন চিরস্থায়ী নয়। স্বার্থের কারণে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ মানুষটিও পর হয়ে যেতে পারে। আবার রক্তের সম্পর্কবিহীন মানুষও আপন হতে পারে। এই আপন হবার বিষয়টি মানুষের নৈতিকতা এবং সততার ওপর।

এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ