বিবিএস ও ইউএনএফপিএর যৌথ জরিপ
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সহিংসতার সমাধানের পথ খুঁজুন
বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের প্রতি স্বামীর সহিংস আচরণ নতুন নয়, প্রায় প্রাচীনকাল থেকেই এটা কমবেশি চলে আসছে। সম্প্রতি এটা বহুগুণ বেড়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা যায়, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন নারী স্বামীর সহিংসতার শিকার। অর্থাৎ দেশের ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এই সহিংসতার মধ্যে রয়েছে শারীরিক, যৌন, মানসিক, অর্থনৈতিক সহিংসতা এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) যৌথ জরিপে।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, দেশের ৭৬ শতাংশ নারীকেই জীবনে অন্তত একবার জীবনসঙ্গীর সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ গত এক বছরে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সহিংসতার শিকার হওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন ভুক্তভোগী (৬২ শতাংশ) তাদের অভিজ্ঞতা কখনো প্রকাশ করেননি। জরিপের ফলাফলে আরও বলা হয়েছে, ১৫ শতাংশ নারী ১৫ বছর বয়স থেকে সঙ্গী নন এমন ব্যক্তির মাধ্যমে শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২ শতাংশের বেশি যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবে স্বামীর সহিংস আচরণ ২০১৫ সালে ৬৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। জরিপে আরও বলা হয়, কম বয়স, যৌতুক প্রথা, স্বামীর মাদকাসক্তি বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং শহুরে বস্তিতে বসবাস করা নারীরা স্বামীর মাধ্যমে বেশি সহিংসতার শিকার হন। স্বামীর উচ্চতর শিক্ষা সহিংসতার ঝুঁকি কমায়। কম বয়স, সীমিত শিক্ষা ও প্রতিবন্ধিতার কারণে নারীরা সঙ্গী নয় এমন ব্যক্তির কাছে বেশি সহিংসতার শিকার হন।
বিষয়টি রীতিমতো আতঙ্কজনক ও উদ্বিগ্নজনক। তার মানে আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে আজও নারীর অধিকার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি; কিন্তু এরকম অমানবিক ঘটনা কেন ঘটছে তার কারণটিও অনুসন্ধান করা জরুরি। তা না হলে সমাধানের পথও জানা যাবে না। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ ধরনের অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক অসহায় নারী নিরুপায় হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই নিজের সংসার জীবনের অশান্তির কথা লিখে দিচ্ছেন। অনেকে হয়তো লিখতে পারছেন না, গোপনে গোমড়ে গোমড়ে কেঁদে মরছেন। অনেক নারী স্বামীর নির্যাতনের শিকার হলেও কারও কাছে তা প্রকাশ করেন না। সম্প্রতি জনপ্রিয় এক ধর্মীয় বক্তার স্ত্রীর বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। স্বামীর অত্যাচার-নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে অনেক নারী বেছে নিচ্ছেন ছাড়াছাড়ির পথ, কেউ-বা আত্মহত্যাও করছেন।
সরকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। আয়ের বৈষম্য, নারী-পুরুষের সমতার অভাবই যে নারী সহিংসতার পেছনে মূল কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা কথা প্রচলিত আছে যে, যে কোনো সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজের পরিচয় সে সমাজে নারী-পুরুষের সমতা কতখানি তার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে স্ত্রীর প্রতি স্বামীদের সহিংস আচরণ মূলত নানারকম অশিক্ষা, অনিশ্চয়তা, নারীর সামাজিক ও আর্থিক দুর্বলতাগুলোর কারণেই হয়। এসব নিয়ে বহু বছর ধরেই অনেক কথা ও গবেষণা হয়েছে; কিন্তু যথাযথ ফলাফল কেন পাওয়া যাচ্ছে না তা ভাবতে হবে।
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে সরকারকে আরও ব্যাপক পরিসরে গবেষণা করতে হবে এবং তার সমাধানের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা না গেলে, নারীকে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী করতে না পারলে কোনো গবেষণায়ই কাজ হবে না। তাই নারীর প্রতি স্বামীর সহিংস আচরণ বন্ধ করতে হলে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো ও আর্থিক সমতা প্রতিষ্ঠাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। তার জন্য সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে