যুদ্ধবিরতির আগে ‘শেষ পাল্টাপাল্টি হামলা’: ইরানে নয়জন নিহত, ইসরায়েলে চারজন

সংঘাতের ১২তম দিনে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেছে ইরান ও ইসরায়েল। এর আগ মুহূর্তে ইরানে হামলায় কমপক্ষে নয়জন নিহত, ৩৩ জন আহত এবং চারটি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, যার পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটি।

অন্যদিকে ইসরায়েলে কয়েক দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চারজন নিহত ও ২২ জন আহত হয়েছেন। এটিকে যুদ্ধবিরতির আগে ‘শেষ হামলা’ বলে অভিহিত করেছে ইরানের অভিজাত সামরিক বাহিনী ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) উত্তর ইরানের আস্তানেহ-ইয়ে আশরাফিয়া শহরে ‘সন্ত্রাসী’ হামলায় নয়জন নিহত ও ৩৩ জন আহত হওয়ার খবর জানিয়েছে গিলানের গভর্নরের কার্যালয়। ডেপুটি গভর্নর বলেছেন, নিহত বা আহতদের মধ্যে ১৬ জন নারী ও শিশু। ইরানি গণমাধ্যম দাবি করছে, এই হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে।

বিবিসি ও আল জাজিরা জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ইরানের সিনিয়র পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহাম্মদ রেজা সেদ্দিকিও রয়েছেন। তাকে হত্যার কথা উল্লেখ করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও।

অন্যদিকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বিয়েরশেবা শহরে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাঁচজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসির অ্যারাবিক সার্ভিস।

ইসরায়েলি জরুরি সেবা ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) ও,অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস জানায়, কয়েক দফা হামলায় আরও ২২ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা মাঝারি এবং ২০ জনের অবস্থা সামান্য, প্রধানত কাটা, হাত-পায়ের জখম এবং আতঙ্কজনিত উপসর্গে ভুগছেন তারা।

একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের চতুর্থ তলায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া তিনজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। সাততলা ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন এবং তাকে উদ্ধারে তল্লাশি অভিযান চলছে।

উদ্ধারকাজ ব্যাহত ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে সাধারণ নাগরিকদের ঘটনাস্থলে না যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

ইসরায়েলের উত্তরের শ্যারন ও হাদেরা অঞ্চলেও ক্ষেপণাস্ত্রের খণ্ডাংশ আঘাত হানায় একজন ১৫ বছর বয়সী কিশোর আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এমডিএ’র জ্যেষ্ঠ প্যারামেডিক শিমরিত সেলা বলেন, ‘আমরা যখন ঘটনাস্থলের দিকে এগোচ্ছিলাম, তখন ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠতে দেখি। গিয়ে দেখি, একাধিক ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। একটি ভবনের প্রবেশপথে এক ব্যক্তিকে অচেতন অবস্থায় পাই। ভেতরে গিয়ে আরও একজন পুরুষ ও একজন নারীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করি। আমরা আহতদের চিকিৎসা দিতে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছি এবং ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসা বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি’।

দেশটির ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিসও জানায়, এলাকাটির একাধিক ভবনে ধ্বংসযজ্ঞ দেখা গেছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এসএনএন জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে ইসরায়েলের দিকে ‘শেষ দফা ক্ষেপণাস্ত্র’ ছুড়েছে দেশটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত যুদ্ধবিরতি স্থানীয় সময় সকাল সাতটা থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও ইরান ওই সময়ের পরও উত্তরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে গেছে। ইরানি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এসএনএন জানায়, চার দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর তেহরান স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ২০ মিনিট নাগাদ যুদ্ধবিরতি মেনে চলে।

এসব পাল্টাপাল্টি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর, দয়া করে লঙ্ঘন করবেন না’। আর ইরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার খবর জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর ইসরায়েল জানিয়েছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি আছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনও (আইআরআইএনএন) জানিয়েছে, কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ‘সফল’ হামলার পর ইসরায়েলের ওপর এই যুদ্ধবিরতি ‘চাপিয়ে দেয়া হয়েছে’। নিউজ চ্যানেলটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইরানের হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির জন্য ‘মিনতি’ করেছিলেন।

উপস্থাপকের পড়ে শোনানো বিবৃতিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বা আইআরজিসি সেনাবাহিনীর প্রশংসা করা হয় এবং ইরানিদের প্রতিরোধকে সম্মানও জানান হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মতির কথা জানিয়ে ইসরায়েল সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইরানের চালানো হামলায় তাদের লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় তারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। এটি লঙ্ঘন করা হলে ইসরায়েল এর কঠোর জবাব দেবে’।

বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েল ‘ইরানের সামরিক নেতৃত্বের ওপর গুরুতর আঘাত হেনেছে এবং ইরানের কেন্দ্রীয় সরকারের অন্তত কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করেছে’।

গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানের কেন্দ্রস্থলে সরকারি লক্ষ্যবস্তুতে মারাত্মক হামলা চালিয়ে শত শত আধা সামরিক বাহিনীকে নির্মূল করেছে বলেও বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে। এই মিলিশিয়া বাহিনীটিকে ইরান সরকার প্রায়ই বিক্ষোভ দমন করতে ব্যবহার করতো।

বিবৃতির শেষে প্রতিরক্ষায় সহায়তা এবং ইরানের পারমাণবিক হুমকি নির্মূলে অংশগ্রহণের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানায় ইসরায়েল।

এর আগে সোমবার (২৩ জুন) পর্যন্ত সংঘাতের ১১ দিনে ইরানে প্রায় ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের বরাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছেন আরও তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে ইরানের মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস ইন ইরান’ নিহত মানুষের সংখ্যা এর প্রায় দ্বিগুণ বলে মনে করে।

অন্যদিকে হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত ও এক হাজার ৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির জরুরি চিকিৎসা সেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদম।