Views Bangladesh Logo

কাজী নজরুল ইসলামের অন্তিম দিনগুলো

 VB  Desk

ভিবি ডেস্ক

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে কত হাজার হাজার লেখা হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। মাইকেল এইচ হার্ট রচিত ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষী’র জীবনীগ্রন্থে উল্লিখিত সর্বকালের সেরা মনীষীদের একজন কাজী নজরুল ইসলাম। কবির সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। একেবারেই ছোট করে যদি বলা হয়, বিদ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুল। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তার লেখালেখি ধুমকেতুর মতো জাগিয়ে তুলেছিল ভারতবাসীকে। সে কারণেই তিনি উপাধি লাভ করেন বিদ্রোহী কবি। তিনি সাম্রাজ্যবাদ, নিপীড়ন, অনাচার, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে অগ্নিকণ্ঠে সোচ্চার হয়ে লিখেছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গান। বিদ্রোহী কবি হলেও তার প্রেমিক রূপ ছিল প্রবাদপ্রতিম। এ লেখার আলোচনার বিষয়বস্তু কবির শেষ দিনগুলো নিয়ে।

মানবপ্রেমিক, চির দুর্দম, বিদ্রোহী, পরোপকারী, স্বাধীনচেতা কবিও এক সময় জীবনের কাছে হেরে গেলেন। অসহায় শিশুর মতোই এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন মস্তিষ্কের দুরারোগ্য কঠিন ব্যাধিতে। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই। এর আগে ১৯৪০ সালে কবিপত্নী প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। স্ত্রী সুস্থতার জন্য কবি অজস্র অর্থ ব্যয় করেন। কিস্তিতে কেনা মোটরগাড়ি, বালিগঞ্জের ভক্তের দান করা জমি, গ্রন্থাবলির কপিরাইট, রেকর্ড করা গানের রয়্যালটির টাকা সবই স্ত্রীর চিকিৎসায় খরচ করেন, কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি। এদিকে অসুখের জন্য কবির কথা বলার ও লেখার শক্তি হারিয়ে যায়। ১৯৪২ সালের ১৭ আগস্ট কবির অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুজপ্রতিম সুফি জুলফিকার হায়দারকে যে পত্র লিখেছিলেন, তাতে তার মানসিক অবস্থার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

পত্রটির কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো, ‘প্রিয় হায়দার, ...Blood pressure-এ শয্যাগত। অতি কষ্টে চিঠি লিখছি। আমার বাড়িতে অসুখ, ঋণ, পাওনাদারের তাগাদা প্রভৃতি worries, সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাটুনি। তারপর নবযুগের worries ৩/৪ মাস পর্যন্ত। এই সব কারণে আমার nerves shattered হয়ে গেছে। ৬ মাস ধরে হক সাহেবের কাছে গিয়ে ভিখারির মতো ৫/৬ ঘণ্টা বসে থেকে ফিরে এসেছি।...আমি ভালো চিকিৎসা করাতে পারছি না। ...আমার হয়তো এই শেষ পত্র তোমাকে। ...কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অতি কষ্টে দু-একটা কথা বলতে পারি, বললে যন্ত্রণা সর্বশরীরে। হয়তো কবি ফেরদৌসীর মতো ওই টাকা আমার জানাজার নামাজের দিন পাব; কিন্তু ওই টাকা নিতে নিষেধ করেছি আমার আত্মীয়স্বজনকে।

চিকিৎসার ব্যাপারে অবশ্য প্রথম দিকে বেশ কিছু ত্রুটি হয়েছে এবং বলা ঠিক হবে অবহেলাই করা হয়েছিল। নতুবা কে জানে হয়তোবা আজকের দিনের মতো এমনি এক ‘অসুখ সারাবার নয়’ বলবার মতো দিন না-ও আসতে পারত।’ যত দিন কবিপত্নী প্রমীলা জীবিত ছিলেন, কবির প্রতি যত্নআত্তি ভক্তি ভালোবাসার কোনো ত্রুটি ছিল না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় শুয়ে শুয়ে সংসার চালানো ছাড়াও কবির সেবা শুশ্রূষা করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। কবির যত্নের ব্যাপারে প্রমীলা সম্পর্কে কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী বলেছেন-

‘যত দিন বেঁচে ছিলেন, প্রমীলা বেশিরভাগ দিনই নিজের হাতে বাবাকে খাইয়ে দিতেন। খাওয়া শেষ হলে তার হাতমুখ ধুইয়ে সযত্নে তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতেন। তিনি খাবার পরিবেশন না করলে, বা তার সামনে বসে না খেলে আমাদের তৃপ্তি হতো না। বাবার সম্বন্ধে তার দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যবোধ ছিল অসাধারণ, গভীর রাত্রে সবাই যখন সুপ্তির কোলে নিমগ্ন তখন তিনি একা খেলে চলেছেন হয় লুডো, নয় তাস, নয়তো বা চায়নিজ চেকার। উদ্দেশ্য, বাবাকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দেয়া। কারণ, বাবা ঠিক এক নাগাড়ে ঘুমোতেন না।

তাই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঝে মাঝে শুনতে পেতাম, ঠক ঠক করে গুটির আওয়াজ হচ্ছে আর থেকে থেকে একটি কণ্ঠস্বর বলে উঠছে- এসো, বাইরে যেও না। শোনো, শুয়ে পড়ো।’ জীবনের শেষ দুই দশকেরও বেশি সময় নজরুল কাটিয়েছেন একেবারে জীবন্মৃত অবস্থায়। তার সৃজনপ্রতিভা তো বটেই, বাকশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিও একেবারে লোপ পেয়েছিল। ১৯৫৩ সালেই ডাক্তাররা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন- ‘বর্তমান অবস্থায় কোনো প্রকার সার্জারি করলে রোগীর জন্য তা হিতে বিপরীত হতে পারে। রোগী একরকম চিন্তাহীন, শান্ত, শিশুর মতন (childlike) অবস্থায় আছেন, তাকে সেভাবেই থাকতে দেয়া উচিত, কেন না এর চেয়ে ভালো কোনো অবস্থায় তাকে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।’

নজরুলের ঠিক কী রোগ হয়েছিল সে নিয়ে কিছু ধোঁয়াশা প্রচলিত। ১৯৫৩ তেই Dr. Hans Hoff-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘রোগটি সম্ভবত GPI (General Paralysis of Insane) নয়, বেশ সম্ভব এটি এক ধরনের Pseudo- Paralytic Condition caused by Meningo- Vascular Syphilis। রোগ বর্তমানে এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে সার্জারিতে কোনো প্রকার সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’ এই অবস্থায় নজরুল বেঁচে ছিলেন আরও ২৩ বছর।

১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুলের তিয়াত্তরতম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন ভারত সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বিপুল সমারোহে কবিকে ঢাকায় নিয়ে যান। ততদিনে কবি সম্পূর্ণ বোধরহিত, কার্যত অবচেতন। বিমানবন্দরে কয়েক লক্ষ অনুরাগীর প্রবল উচ্ছ্বাস, রাজকীয় সংবর্ধনা, বিলাসবহুল বাসভবন, স্বাচ্ছন্দ্যের সতর্ক আয়োজন- এসব কিছুই তিনি টের পাওয়ার অবস্থায় ছিলেন না।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৪১ সালের ৬ই এপ্রিল মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি রূপে নজরুল এই অভিভাষণ দান করেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাবার পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা। কাজী নজরুল ইসলাম শেষ ভাষণে বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে- আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের, সকল মানুষের...।’

নজরুল সংগীত গুরু ধীরেন বসু কবি সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ঢাকায় কবির ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে কাজী সব্যসাচী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী কাজী, ধীরেন বসু সবাই কবিকে মাল্যদান করতে গেছেন, কিন্তু কবি কিছুতেই মাথা তুলছেন না। এমতাবস্থায় কাজী সব্যসাচী ধীরেন বসুকে বললেন, ‘ধীরেন তোমার গাওয়া সেই গানটি ধরো।’ হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে ধীরেন বসু গাইলেন, ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি।’ গান শেষ হলো, কবি মাথা তুলে সবাইকে দেখলেন, মাল্যদানের পালা শেষ হলো। চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকলেও ক্রমশ অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে কবির। জীর্ণ শরীরটাকে আক্রমণ করে জ্বর ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমিত। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার, সকাল ১০টা ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন কবি।

আমাদের জাতীয় জীবনের যে কোনো সংকট, দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে কাজী নজরুল ইসলাম চির প্রাসঙ্গিক। জাতির যে কোনো সংকটে কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে শক্তি ও প্রেরণা নিয়ে এগিয়ে গেলে তবেই আসবে আমাদের সাফল্য। কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম প্রয়াণবার্ষিকীতে তার স্মৃতি ও সৃষ্টির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ