ভোটের ‘মহোৎসব’ আর জাতির ‘নবজন্ম’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একেবারে কবির ভঙ্গিতে জাতিকে চমকে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। তবে সেটা কেবল সাধারণ কোনো নির্বাচন নয়, বরং মহোৎসবের নির্বাচন। আর এই মহোৎসব কেবল ভোটের মহড়া নয়, সেটি হবে জাতির নবজন্ম। তবে এখানে একটি শর্তও জুড়ে দিলেন তিনি- ‘যদি ঐকমত্যের মাধ্যমে ফয়সালা করতে পারি।’ শর্তটা শুনেই গলা আটকে যায়। কারণ ঐকমত্য শব্দটা আমাদের অভিধানে এতটাই বিরল যে, মনে হয় এটি কোনো লুপ্তপ্রায় প্রাণী।
আমাদের সংসদে ঐকমত্য মানে হলো টেবিল ঠুকতে ঠুকতে গলা ফাটিয়ে কথা বলা। রাস্তায় ঐকমত্য মানে একে অপরের ব্যানার ছিঁড়তে ছিঁড়তে শেষে কিল-ঘুসি চালানো। পরিবারের ঐকমত্য মানে- ফ্রিজের ভেতর শেষ টুকরো মুরগির রানটা নিয়ে যুদ্ধ। আর প্রেমিক-প্রেমিকার ঐকমত্য মানে হলো- কে বেশি কষ্ট পেয়েছে আর কে বেশি অপরাধী, সেটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক। এমন এক জাতির মধ্যে ঐকমত্য কীভাবে আসবে, সেটা নিয়ে শেক্সপিয়রও নাটক লিখে ফেলতে পারতেন।
এরপর যখন তিনি ঘোষণা দিলেন যে, নির্বাচন হবে মহোৎসব, তখন তো হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ! মহোৎসব! আমাদের জাতি এমনিতেই মহোৎসব-আসক্ত। ক্রিকেট জিতলেও মহোৎসব, হেরে গেলেও মহোৎসব- কারণ তখনো আমরা গর্বের সঙ্গে বলি, ‘আমরা মরতেও শিখেছি।’ ঈদে মহোৎসব, পূজায় মহোৎসব, নববর্ষে মহোৎসব। এমনকি পাড়ার চায়ের দোকানে চা খেতে গেলেও মনে হয় উৎসব। বাসের হেলপার যদি ভুলে ভাড়া না তোলে, সেটাকেও আমরা মহোৎসব বানিয়ে ফেলতে পারি। এমন জাতির হাতে আর কত মহোৎসব ধরিয়ে দেয়া সম্ভব? এখন যদি ভোটও মহোৎসব হয়ে যায়, তবে তো ঈদের দিন গরু কাটার লাইনেও স্লোগান উঠবে- ‘গরু কাটো, মহোৎসব করো!’
কিন্তু সবচেয়ে বড় ধাঁধা লুকিয়ে আছে ‘জাতির নবজন্ম’ কথাটায়। আমাদের জাতির আসলে কয়টা জন্ম? ১৯৪৭-এ একবার জন্ম নিলাম, ১৯৭১-এ আবার জন্ম নিলাম। তারপর প্রতিটি সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ঘোষণা হলো- দেশের নতুন জন্ম, নতুন সূচনা। তাহলে আমাদের জন্মসনদে লিখতে হবে- ’জন্ম: বহুবার।’ বারবার জন্ম নিলে তাকে কি নবজাতক বলা যায়? নাকি ‘চিরকালীন শিশু’? যদি আবার সত্যিই নবজাতক হতে হয়, তবে তো আবার ডায়াপার পরতে হবে, কোলবালিশে ঘুমাতে হবে, সারাদিন কাঁদতে হবে। এই জাতির আবার এত ঝামেলা কেন নিতে হবে?
আসলে আমরা তো এমনিতেই সুখে আছি। আমাদের সুখের সংজ্ঞা একটু অন্যরকম। কারও মাথায় ইট পড়লে আমরা হাসি, কেউ ভোরে মাইক বাজালে আমরা নাচি, কেউ গালি দিলে আমরা তার মধ্যে কাব্যিকতা খুঁজি। এভাবে আমরা শুধু টিকে আছি তাই নয়, সমৃদ্ধিও লাভ করছি। তেলাপোকাও একদিন পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে; কিন্তু আমরা হব না। কারণ দলাদলি, হানাহানি, ভাঙচুর, মারামারি- এসবের মধ্যে আমরা অমরত্ব খুঁজে পেয়েছি। আমাদের ধ্বংস নেই, নজরুলের মতো আমরাও অমর অক্ষয়, অব্যয়।
তাহলে প্রশ্ন হলো- আমাদের যখন ধ্বংসই নেই, তখন নবজন্মের দরকার কী? নতুন জন্ম তো তখনই দরকার হয়, যখন পুরোনো জীবন শেষ হয়ে যায়। আমরা তো মরতেই শিখিনি। আমাদের ভোটের বাক্স চুরি হয়, ব্যালট উধাও হয়, বুথে ঢুকতে গিয়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়, মানুষ গুম হয়- তবুও আমরা আবার দাঁড়িয়ে যাই। হাসি, আড্ডা দিই, ফেসবুকে মিম বানাই। তাহলে নতুন জন্মের শখ কেন? নাকি নবজন্ম মানে এবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সবাই একসঙ্গে আঙুলে কালি লাগাবে, তারপর সেলফি তুলবে?
মনে হয়, নবজন্মের এই ধারণাটা মূলত এক ধরনের ‘মার্কেটিং কৌশল’। ভোটকেন্দ্রে মানুষকে টানতে হলে তো একটু রঙিন স্লোগান দিতে হয়। শুধু ‘নির্বাচন হবে’ বললে কে যাবে? তাই বলা হলো- মহোৎসব হবে, নবজন্ম হবে; কিন্তু বাস্তবে যদি দেখা যায় বুথে বিদ্যুৎ নেই, ব্যালট বাক্স নেই, কিংবা আছে কিন্তু আগেই ভর্তি- তখন মহোৎসবের বদলে শবযাত্রা হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আমরা জাতি হিসেবে এতটাই ঐকমত্য-বিমুখ যে, কেউ যদি বলে ‘আজ আকাশ নীল,’ তখনো আরেকজন এসে বলবে, ‘না, আকাশ আসলে হালকা মেটে।’ কেউ যদি বলে ‘ভাতের সঙ্গে মাছ খেতে মজা,’ আরেকজন চেঁচিয়ে উঠবে, ‘না, মাছের সঙ্গে ভাত খেতে মজা।’ মানে, আমরা এমন এক জাতি যাদের কাছে ঐকমত্য মানে হলো নতুন করে ঝগড়া শুরু করা।
তাহলে নির্বাচনে ঐকমত্য কোথায়? যদি সব দল সত্যিই ঐকমত্যে পৌঁছে যায়, তবে তো নির্বাচনই হবে না। কারণ সবাই একসঙ্গে জয়ী হবে। হয়তো সংসদে দেখা যাবে, সবাই হাত ধরে নাচছে। টিভি ক্যামেরায় দেখা যাবে এমপি-মন্ত্রীদের হাতে ঢোল-বাঁশি- সবাই গাইছে, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধ, আমরা জয়ী।’ তখন দেশ চালাবে কে? ঐক্যের উল্লাসে কে দায়িত্ব নেবে? এই জটিলতায় আমরা ডুবে আছি, আর প্রধান উপদেষ্টা তখনও আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন- ’মহোৎসব হবে।’
এই প্রসঙ্গে মেক্সিকোর এক পর্যটকের গল্প খুব মানিয়ে যায়। তিনি সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে দেখলেন কিছু জেলে খুশিমনে মাছ ধরছে, গান গাইছে। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রতিদিন কতক্ষণ মাছ ধরো?’ জেলেরা বলল, ‘বেশিক্ষণ না।’ পর্যটক তখন গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি হার্ভার্ড থেকে এমবিএ করেছি। তোমাদের একটা দারুণ আইডিয়া দিচ্ছি। বেশি মাছ ধরো, বেশি বিক্রি করো। টাকা জমাও, বড় নৌকা কিনো। এরপর আরও বেশি মাছ ধরো, আরও টাকা কামাও, নিজের ফ্যাক্টরি খোলো। একসময় শেয়ারবাজারে ঢুকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করবে।’ জেলেরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’ পর্যটক গর্বভরে বললেন, ‘তারপর অবসরে যাবে। গ্রামে ফিরে এসে সমুদ্রের ধারে ঘুমাবে, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলবে, স্ত্রীর সঙ্গে খাবে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবে।’ জেলেরা তখন হেসে বলল, ‘ভাই, এই কাজটাই তো আমরা এখন করছি! তাহলে বিশ-পঁচিশ বছরের কষ্ট করতে যাব কেন?’
এই গল্পটা শোনার পর মনে হয়- আমাদের নির্বাচনের অবস্থাও প্রায় একই। আমরা যেমন আছি, তেমনই টিকে আছি। ঝগড়া করছি, মারামারি করছি, ভোটের দিন গন্ডগোল করছি- তবুও বেঁচে আছি, আড্ডা দিচ্ছি। এখন কেউ যদি এসে বলে- আরও কষ্ট করো, মহোৎসব করো, নবজন্ম নাও- তাহলে প্রশ্ন করতেই হয়, ‘এত ঝামেলায় যাব কেন? আমরা তো এখনই মহাসুখে আছি।’
তাই প্রধান উপদেষ্টার ‘মহোৎসব’ আর ‘নবজন্ম’ শুনে মনে হয়, তিনি হয়তো ভেবেছেন আমাদের জীবন খুব নীরস। অথচ আসল সত্য হলো- আমরা এমন জাতি, যাদের প্রতিদিনই নবজন্ম হয়। কখনো ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে, কখনো লোডশেডিং-এর মধ্যে ঘেমে-নেয়ে, কখনো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কালি মেখে। মহোৎসব? সেটি আমাদের প্রতিদিনের ডালভাত। ঐকমত্য? সেটি আমাদের অভিধানে সবচেয়ে হাস্যকর শব্দ। আর নবজন্ম? আমরা তো প্রতিদিনই জন্ম নিচ্ছি, তাই নতুন জন্মের কোনো উত্তেজনা আমাদের মধ্যে নেই।
সবশেষে বলতে হয়- মহোৎসবের নির্বাচন শুনতে যতটা কাব্যিক, বাস্তবে তা ততটাই ব্যঙ্গাত্মক। আমাদের মহোৎসব মানে হলো হইচই, চেঁচামেচি, ঝগড়া, আর শেষে ‘যদিও’ শব্দ দিয়ে সবকিছু ধুয়ে ফেলা। আর জাতির নবজন্ম মানে- আবারও দলাদলি শুরু করা।
তাহলে আসল সত্যিটা খুব সরল: আমরা এমন জাতি, যারা তেলাপোকার মতো অমর। তাই আমাদের কোনো নবজন্মের দরকার নেই, মহোৎসবেরও দরকার নেই। আমাদের দরকার কেবল পুরোনো অভ্যাস ধরে রাখা- ঝগড়া, মারামারি, দলাদলি। এটাই আমাদের ঐকমত্য। আর এটাই আমাদের চিরন্তন মহোৎসব।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে