মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা এবং তারপর...
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী শক্তির উত্থানের পেছনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা একটি কারণ তো বটেই, তারা তো কোনো কিছু দিতে পারল না। তরুণদের ভবিষ্যতের স্বপ্নটা দেখাতে পারলেন না। স্বপ্ন তো বাস্তবায়িত হলো না, এটা এক। দ্বিতীয় হচ্ছে যে, বেকারত্ব বেড়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে। যখন মানুষ বেকার হয়, দরিদ্র হয় তখন সে আশ্রয় খোঁজে, ভরসা খোঁজে; কিন্তু এখানে আশ্রয় এবং ভরসা সমাজ ও রাষ্ট্র তাকে দিচ্ছে না। মানুষ নিজেই নিজের জন্য সংগ্রাম করছে, বেকার থাকছে, হতাশায় ভুগছে, সে সুবিচার পাচ্ছে না, আশ্রয় পাচ্ছে না। সুবিচারের জন্য, আশ্রয়ের জন্য, সে তখন ধর্মের কাছে যায়। এই আশায় যে ধর্মে একালে না হলেও পরকালে একটা বিচার পাবে।
ধর্ম তাকে একটা ভরসা দিচ্ছে যে ন্যায়বিচার আছে, সে এটাতে প্রতিষ্ঠিত হবে। আর আরেকটি বিষয় হচ্ছে পরিবর্তন না হওয়া এবং অবস্থার উন্নতি না ঘটা। যে স্বপ্নটা ছিল সে স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল এবং বাংলাদেশ একটা বিধ্বস্ত স্বপ্নের দেশে পরিণত হলো। তাই হতাশার কারণে, বেকারত্বের কারণে, দারিদ্র্যের কারণে মানুষ ধর্মের কাছে যাচ্ছে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা।
একটা ভয়ংকর জিনিস এখানে তৈরি হয়েছে। আমাদের শাসকগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের কখনো মাদ্রাসায় পাঠাবে না, পাঠাবে ইংরেজি মাধ্যমে; কিন্তু তারা মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করে। দুই বিশেষ কারণে করে। এক, তারা মনে করে এটা ধর্মীয় কাজ এবং এটাতে সুনাম হবে সহজে। অল্প পয়সায় সামাজিক একটা সুনাম হয়। আর পরকালেও একটা জায়গা হয়। ইহকালে অনেক অন্যায় করছে, তার বিপরীতে ভালো সওয়াব পাওয়া যাবে।
দুই, তাদের মধ্যে অস্পষ্ট হলেও একটা ইচ্ছা আছে যে, গরিব মানুষকে আরও গরিব করে রাখতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় গরিবরা যায়, ওখানে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়। এই গরিবির যে বন্ধন এটা একটি চক্র, সেখানে ওরা আটকে গেল। মাদ্রাসার ছেলে সে তো আর ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তার দুটি অসুবিধা। একটা হচ্ছে সে এমন কোনো উপযোগী বিদ্যা পায়নি, যার বলে উৎপাদনে অংশ নিতে পারে, দ্বিতীয়ত, তার মধ্যে একটি অহমিকা জুটেছে যে, সে শিক্ষিত। কেবল শিক্ষিত নয়, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। কাজেই সে নৈতিকভাবে অন্য শিক্ষিতদের চাইতে উন্নত। সেজন্য সে বেকার থাকছে, হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এই মাদ্রাসাগুলো থেকেই জঙ্গিগুলো আসছে। এই জঙ্গি শিক্ষা এবং এই মাদ্রাসা শিক্ষা একসঙ্গে প্রবাহিত।
পাকিস্তান এক সময় মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছিল। তালেবানদের তারা তৈরি করছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়বে বলে। পাকিস্তান এখন মাদ্রাসা নিয়ে বিপন্ন বোধ করছে, মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে এবং মাদ্রাসার সিলেবাস আধুনিকীকরণের চেষ্টা করছে। বিধি চালু করেছে যে, তথাকথিত কওমি মাদ্রাসা সেগুলোও এখন ওখানে করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষা যে কি রকম বিপজ্জনক হতে পারে, সেটা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও ওই মাদ্রাসা শিক্ষার যত বিস্তার হচ্ছে, ততই আমরা জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করছি এবং তাদের লালন-ভূমিকে পরিপুষ্ট করছি। আমাদের সরকারগুলো প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করছে, কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে মাদ্রাসা শিক্ষায়। মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করার কথা তো ভাবছেই না, যত পারা যায় বাড়াচ্ছে।
সমাজে এই নানারকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ উঠছে না কারণ এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাগ হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে ভূমিকা ছিল সে ভূমিকা ছাত্রদের কার্যক্রমে আমরা দেখেছি না। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ উঁচুতে উঠে গেছে। আরেকটা অংশ নিচুতে নেমে গেছে। যারা উঁচুতে উঠে গেছে তারা পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত শাসকশ্রেণির অংশ হয়ে পড়েছে। আর যারা নিচের দিকে নেমে গেছে তারা জীবিকার সংগ্রামে, জীবন সংগ্রামে বিধ্বস্ত হচ্ছে। কাজেই শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তরা আজ প্রতিবাদী ভূমিকাটা পালন করতে পারছে না; কিন্তু এই শ্রেণির মধ্যেই মানুষগুলো আছে যারা সমাজের পরিবর্তন চায়। সেই মানুষগুলো কিন্তু আলোচনা করে। নিজেদের মধ্যে চিন্তা করে, অনুভব করে; কিন্তু সংগঠিত একটা আন্দোলন আমরা গড়ে তুলতে পারিনি যেখানে এরা আসবে। এই নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিই কিন্তু নিয়ামক। এরাই চায়ের দোকানে আলোচনা করে, এরাই খবরের কাগজ পড়ে। এরাই ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলে; কিন্তু এরা যে সংগঠিত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হবে, বিকল্প মানে বাম বিকল্প; সেই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। এই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি শাসকশ্রেণির ওপরে বিক্ষুব্ধ, তারা সমালোচনা করে কে ঘুষ খাচ্ছে, কতটা খাচ্ছে তা নিয়ে হাসাহাসি করে, কোনো শ্রদ্ধা রাখে না, কিন্তু তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং বিকল্পটা তৈরি করতে হবে আজ। এই বিকল্পটা ডান দিক থেকে আসবে না সেটা আসবে বাম দিকে থেকে।
অতীতে পশ্চিমবঙ্গে বামদের সাফল্য দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেছে এখানে কেন হলো না। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বামপন্থি কিন্তু এক না। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে যারা কার্যকর তারা প্রায় ৫০ বছর এগিয়ে ছিল আমাদের তুলনায়। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। তারা লেখাপড়ায় এগিয়ে, চাকরিবাকরিতে এগিয়ে। আমাদের মধ্যবিত্ত কিন্তু সত্যিকার অর্থে পাকিস্তান আমলেই তৈরি হলো। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাম দিকে যাওয়ার সময়ে তাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধ এসে তাদের স্বাধীন করে অনেক সুযোগ-সুবিধা এনে দিল। রাষ্ট্র তখন তাদেরকে নিজের পক্ষে টেনে নিল। রাষ্ট্র তাদের টেনে নিয়ে রাষ্ট্রের সেবক, রাষ্ট্রের দাসে পরিণত করল এবং জনগণের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দিল।
এখানে বাম আন্দোলনে একসময়ে যারা নেতা ছিলেন তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। ১৯৪৭ সালের পরে নিপীড়িত হয়ে, লাঞ্ছিত হয়ে কেউ আত্মগোপন করলেন, অনেককে জেলেও থাকতে হলো, কেউ কেউ চলে গেলেন ওপারে। তাতে একটা শূন্যতা তৈরি হলো। তখন মুসলমান বামপন্থি তৈরি হচ্ছিল মাত্র কিন্তু তারা তৈরি হতে পারে নাই। কেননা তাদেরকে পাকিস্তান আন্দোলনে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তারা তৈরি হওয়ার মুহূর্তে একটা শূন্যতা এসে গেল, ১৯৪৭-এর শূন্যতা। আবার এলো ১৯৭১-এর শূন্যতা, যেটি একদিকে সুযোগ এনে দিল। আরেক দিকে বামপন্থিরা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তারা দাঁড়াতে পারল না তাদের নিজেদের অবস্থানে।
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রতিক্রিয়া আমরা এখনো ভীষণভাবে বহন করছি। প্রথমত, মেধাবী অনেক মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন এটা আমাদের একটা ঐতিহাসিক পরাজয়। এতে বোঝা গেল এরপরে ন্যায়বিচার এখানে পাওয়া যাবে না। এখানে এগুলো চলতে থাকবে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরেও আরো অনেক হত্যাকাণ্ড চলেছে, তারও কোনো বিচার হয়নি। কাজেই বিচারের ব্যর্থতাটাও মানসিকভাবে খুবই ক্ষতিকর হয়েছে আমাদের জন্য। সাংস্কৃতিকভাবেও ক্ষতিকর হয়েছে। আলবদর, রাজাকাররা এখন আবার রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায় পেয়ে বসেছে, রাষ্ট্র ও সরকারের আশকারায়। যে নিজামী আলবদর বাহিনীর সংগঠক ছিল, সে যখন মন্ত্রী হয়েছিল, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই ব্যর্থতার বোধটা জাগে যে, যারা শহীদ হলেন তাদের শহীদ হওয়াটা কোনো কাজে দিল না। তাদের যারা নিশ্চিহ্ন করল, তাদের তো রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারলামই না বরং তারা ক্ষমতার ডগায় এখন। এতে একটা ব্যর্থতার বোধ তৈরি করে। কাজেই একদিকে মেধার ঘাটতি ঘটল অন্যদিকে ব্যর্থতার বোধ তৈরি হলো, তৈরি হলো হতাশা।
তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। যদিও জামায়াত একটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে, দেশে মৌলবাদী শক্তি বিকশিত হয়েছে, কিন্তু তারা বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। তবে তারা ক্ষমা চায়নি। তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। তারা তো মুনাফেক।
অনেকে মন্তব্য করে প্রশাসনে জামায়াতের লোক বিভিন্ন বড় বড় পদে চলে এসেছে এবং তারা অন্যদের তুলনায় যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে। প্রশাসনকে কুক্ষিগত করার মিশন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে জামায়াত তাদের লোকদের বিভিন্ন জায়গায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সফল হয়েছে। তাদের নানান জায়গায় বসানো হয়েছে, সরকারের আশ্রয় থেকেই। সে লোকগুলো যোগ্য একথা বলা যাবে না। বসানোর পর তারা ক্ষমতা পেয়ে গেছে। ক্ষমতা পাওয়ার পর তাদের লিপ্সা আরও বেড়েছে। তারা যে জামায়াতী হয়েছে তার কারণ দেখা যাবে আধুনিক যে শিক্ষা, গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধ সেটা তারা ধারণ করতে পারেনি। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষগুলোই জামায়াতের সমর্থক হয়েছে। খুঁজলে দেখা যাবে তাদের মধ্যেও ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতাজনিত হতাশা আছে। মূল কারণ সেটাই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে