ডাকসু নির্বাচন থেকে অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা, প্রভাব ও অদৃশ্য চাপ কাজ করছে। এর ভেতরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন নতুন করে সামনে এনেছে এক অনিবার্য প্রশ্ন- আমরা কি আদর্শ, শিক্ষা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে এগোতে চাই, নাকি আবারও পুরোনো দলীয় আধিপত্যের চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব?
শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে শিক্ষার জন্য, নিজের মেধা ও দক্ষতা বিকাশের জন্য; কিন্তু প্রথাগত রাজনৈতিক চাপ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব তাদের পথকে জটিল করে তোলে। এই নির্বাচন শুধু একটি ভোটের লড়াই নয়; এটি শিক্ষার্থীর নীতি, আদর্শ এবং নেতৃত্বের যাচাই।
ডাকসু নির্বাচন ও বড় দলের আধিপত্য
ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই রাষ্ট্রের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। এবারের নির্বাচনে ভিপি পদে অনেক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বড় দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে। তাদের প্রচারণা, মাঠ নিয়ন্ত্রণ, ভোট সংগ্রহ- সবকিছুই দলের শক্তি দিয়ে পরিচালিত; কিন্তু এর মাঝেই শামীম হোসেনের মতো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়বে, তখন তাদের হয়ে সেই কণ্ঠস্বর তুলে ধরব। আমি হব সেই ভয়েস।’
এটি নিছক নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি নয়। এটি একটি দৃষ্টান্ত- কীভাবে নিরপেক্ষ শিক্ষার্থী নেতৃত্ব দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেও বিকশিত হতে পারে; কিন্তু বড় দলের প্রভাবশালী যন্ত্রের মাঝে এই কণ্ঠস্বর টিকে থাকবে কি না, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতি-চিন্তার ছায়া
আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এক ধরনের বিপজ্জনক ছায়া নেমে এসেছে। ক. ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়া মানে বাড়তি সুবিধা: হলে আসন, ক্যাম্পাসে প্রভাব, বাইরে অতিরিক্ত সুযোগ- এগুলো এখন দক্ষতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যের ফল। ক্ষমতা আছে বলে কিছু পাওয়া, প্রতিভা আছে বলে নয়- এটি কি আমরা চাই? খ. শিক্ষকরাও কি বাকি নেই? অনেকে মনে করেন, ক্ষমতাসীন শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলে পেশাগত সুবিধা নিশ্চিত হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শিক পরিবেশ ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানদণ্ডও ক্ষয় হচ্ছে। গ. শিক্ষার্থীর আসল উদ্দেশ্য কি এটি? তারা এখানে এসেছে নিজের মেধা, যোগ্যতা ও সৃজনশীলতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। তারা শিক্ষা শেষে নেতৃত্ব দেবে- শিল্প, কলকারখানা, প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বত্র। এখনই তাদের নিজের শক্তি তৈরি করার সময়, সাহায্য নেওয়ার নয়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে- যে কালসার বা নেতৃত্ব তৈরির জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা, সেটি কি তৈরি হচ্ছে? নাকি শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর দখল করে নিয়েছে বাইরের দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও অযোগ্য রাজনীতিবিদরা? ছাত্ররাজনীতিতে তাদের শোভা পাওয়ার কথা কি? নাকি এই প্রভাব আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে আরও দুর্বল, বিভ্রান্ত এবং দিশাহীন করে তুলছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার: আংশিক না গভীর?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করছে, তারা শিক্ষা, নির্বাচন ও প্রশাসন সংস্কার করছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, কিছু প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা- এসবই তাদের উদ্যোগ; কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হলো- তারা কি দীর্ঘমেয়াদি ভিশন দেখছে? তারা কি জানে, আসলে কী করতে হবে? নাকি কেবল আগুন নেভানোর মতো তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো সামলাচ্ছে?
এখন পর্যন্ত তাদের সংস্কার অনেকটাই ওপরের স্তরে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র ও সমাজের গভীরে যে সংকট- দলীয় আধিপত্য, অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতি-আদর্শের অনুপস্থিতি- সেদিকে এখনো স্পষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে শিক্ষা ও রাজনীতি আলাদা দুটি ক্ষেত্র নয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি নির্বাচন, প্রতিটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত। ফলে যোগ্যতা নয়, পরিচয় ও পৃষ্ঠপোষকতা মুখ্য হয়ে ওঠে। সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হয়। নীতি ও আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা সংকুচিত হয়। তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মূল্যবোধ, সাহস ও নেতৃত্বের বিকাশের দিকে মনোনিবেশ করার, যেন তারা নিজেরাই সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিতে পারে।
তবু আশার আলো আছে। বাংলাদেশর তরুণ প্রজন্মের ভেতরে এখনো বেঁচে আছে প্রশ্ন করার সাহস, ন্যায়ের প্রতি আকর্ষণ, এবং নতুন কিছুর স্বপ্ন। সে ক্ষেত্রে ছোট ছোট সাংস্কৃতিক, সাহিত্য ও গবেষণার প্ল্যাটফর্মে নীতি-আদর্শ চর্চার মাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরপেক্ষ আলোচনার চর্চায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতি সমর্থন ও নতুন ধারার নেতৃত্ব গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে সাহস ও শাক্তি অর্জন করতে হবে। এখন প্রয়োজন কেবল সাহস- দলীয় ছায়ার বাইরে দাঁড়িয়ে বলা: আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ অন্যের হাতে ছেড়ে দেব না।
ডাকসু নির্বাচন হয়তো অনেকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ঘটনা; কিন্তু এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সংকেত। একদিকে বড় দলগুলোর রাজনৈতিক আধিপত্য, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের মুক্তচিন্তার আকাঙ্ক্ষা- এই দ্বন্দ্বই নির্ধারণ করবে আমাদের পথচলা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সত্যিই সংস্কার করতে চায়, তবে তাদের প্রথম দায়িত্ব হবে শিক্ষা ও রাজনীতির সীমারেখা স্পষ্ট করা, যোগ্য নেতৃত্বের চর্চার জায়গা তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের কাজ হবে নিজেদের কণ্ঠস্বর বাঁচিয়ে রাখা, দক্ষতা ও আদর্শে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা- যেন তারা সত্যিই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্মাণের নায়ক।
রহমান মৃধা: গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে