৭৮৭ ড্রিমলাইনার নিয়ে ২০১৮ তেই সতর্ক করেছিল মার্কিন এভিয়েশনের প্রতিবেদন

ভারতের আহমেদাবাদে ১২ জুন ২৩২ যাত্রী এবং ১২ জন ক্রুবাহী লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছিল সেটি বোয়িং ৭৮৭ মডেলের। এই মডেলের কোনো উড়োজাহাজের এভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম হলেও বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সিরিজের সব বিমান নিয়ে ২০১৮ সালেই মার্কিন ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এর এক প্রতিবেদন সতর্ক করেছিল।
তাদের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, বোয়িংয়ের ৭৩৭ ও ৭৮৭ মডেলের বিমানে ব্যবহৃত ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচে থাকা লকিং ফিচার নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। যদিও তখন এটিকে ‘অসুরক্ষিত অবস্থা’ বলা হয়নি, কিন্তু এই সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটি যে কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে—তা প্রমাণ করেছে ২০২৫ সালে ভারতের আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা।
এয়ার ইন্ডিয়ার আহমেদাবাদ-লন্ডন ফ্লাইট উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান ২৬০ জন যাত্রী। তদন্তে জানা যায়, বিমানটির দুটি ইঞ্জিনই কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হঠাৎ জ্বালানি বন্ধ করে দেয়। ককপিটে পাইলটদের কথোপকথনে উঠে আসে, তারা নিজেরাও জানতেন না কার কারণে সুইচ বন্ধ হয়েছে। অথচ ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচে থাকা লকিং ব্যবস্থাই এমন অনিচ্ছাকৃত ঘটনা রোধ করার কথা। এই সুইচ চালু বা বন্ধ করতে গেলে পাইলটকে সাধারণত সেটি উপরে তুলে ঘোরাতে হয়—এটাই নিরাপত্তার ন্যূনতম শর্ত। কিন্তু লকিং ব্যবস্থা যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সামান্য কাঁপুনিতেই সুইচ ঘুরে যেতে পারে, বন্ধ হয়ে যেতে পারে ইঞ্জিন, আর মুহূর্তেই আকাশে ভেসে থাকা একটি উড়োজাহাজ পরিণত হতে পারে ধ্বংসস্তূপে।
এফএএ ২০১৮ সালের এক বুলেটিনে বোয়িং ৭৩৭ ও ৭৮৭ মডেলের সুইচে লকিং ফিচার নিষ্ক্রিয় থাকার আশঙ্কা জানালেও তখন সেটিকে 'অসুরক্ষিত' ঘোষণা করেনি। ফলে বাধ্যতামূলক পরীক্ষারও নির্দেশনা ছিল না। কিন্তু আহমেদাবাদের দুর্ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতের ডিজিসিএ ইতোমধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার ড্রিমলাইনার বহরের সুইচগুলো পরীক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছে। ২১ জুলাইয়ের মধ্যে এই কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে তারা। এ ছাড়া ইতিহাদ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজসহ বিশ্বের বড় বড় বিমান সংস্থাগুলোও তাদের বোয়িং বিমানের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ যাচাই করছে।
আহমেদাবাদের দুর্ঘটনা তদন্ত করছে এয়ারক্র্যাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। তারা ১৫ পৃষ্ঠার প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানায়, বিমানটির দুইটি ইঞ্জিনই উড্ডয়নের মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাইলটদের কথোপকথন থেকেও জানা যায়, একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কেন জ্বালানি বন্ধ করলে? যার উত্তরে অপরজন বলেন, আমি করিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া মোটেই স্বাভাবিক নয়। কারণ, ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচে একটি লকিং মেকানিজম থাকে, যা এমন অনিচ্ছাকৃত কাজ থেকে রক্ষা করে। তাদের মতে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা যত ড্রিমলাইনার রয়েছে, পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটিতে ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো জরুরি।
বাংলাদেশ বিমানের বহরেও রয়েছে ছয়টি বোয়িং ড্রিমলাইনার—আকাশবীণা, গাঙচিল, সোনার তরী, হংস বলাকা, রাজহংস ও অচিন পাখি। এগুলোতেও ইতোমধ্যে কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সাফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়নি। তবে বোয়িং থেকে নির্দেশনা এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
তবে বোয়িং নিয়ে বিমান বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। একটি ড্রিমলাইনারের উইন্ডশিল্ড চার বছরের মাথায় ফেটে যাওয়ার ঘটনা, এবং একটি ৭৭৭ মডেল দীর্ঘদিন ইতালিতে পড়ে থাকার ঘটনায় বিমানের ভেতরেও অসন্তোষ দেখা দেয়। এসব ঘটনাকে অস্বাভাবিক ও রহস্যজনক বলে মতামত দিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম।
এদিকে বোয়িংয়ের বিক্রয়োত্তর সেবা না পেয়ে এখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারবাসের দিকেই ঝুঁকছে। এরই মধ্যে বিমানের সদর দপ্তরে এয়ারবাস প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে