Views Bangladesh Logo

চাঁদাবাজি: এক উত্তরাধুনিক বিপ্লবী সংস্কৃতি

‘চাঁদাবাজি’- শব্দটি শুনলেই মনে এক মিশ্র অনুভূতি জাগে। যেন এটি বাংলার নিজস্ব এক লোকজ ঐতিহ্য যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ঘাম, রক্ত আর রাজপথের ধুলোয় মিশে আজকের আধুনিক সমাজে এক স্বতন্ত্র রূপ নিয়েছে। একসময় লাঙল ছিল কৃষকের অস্ত্র, আর এখন তার জায়গা দখল করেছে গেট চাঁদা, মিছিল চাঁদা, ইফতার পার্টি চাঁদা এবং নতুন সংযোজন- আন্দোলনের চাঁদা।


চাঁদাবাজি এখন কেবল অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা। এর মধ্য দিয়ে ভ্রাতৃত্ব, ভয় আর ভক্তির এক অদ্ভুত সমীকরণ তৈরি হয়েছে। ভাইয়ে ভাইয়ে বিশ্বাস, বড় ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য এবং বন্ধুসুলভ হুমকি- এসবই চাঁদাবাজির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আর স্রেফ একটি অপরাধ নয়, বরং অনেকের কাছে এটি সামাজিক যোগাযোগ ও সংহতির এক নতুন মাধ্যম।


চাঁদাবাজি: এক ‘ক্যাম্পাস-ইকোনমি’ চাঁদাবাজি এক শিল্প, যা বেকার তরুণকে রাজনীতিবিদে, ছাত্রকে সংগ্রামীতে এবং নেতাকে মহান করে তোলে। এটি এক ধরনের ‘ক্যাম্পাস-ইকোনমি’। যেখানে অন্য কোথাও স্টার্টআপ শুরু করতে একটি পিচডেক প্রয়োজন হয়, সেখানে এখানে লাগে তিনটি ফেস্টুন, একটি মাইক আর কিছু চাঁদা আদায়ের কৌশল।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচ সমন্বয়ককে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তারের খবর জাতি অবাক হয়ে শুনেছে। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেবল অবাক হননি- তিনি ‘বেদনায় নীল’ হয়ে গিয়েছেন।


‘নীল হওয়া’ এক গভীর রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ‘নীল হওয়া’ বাংলার রাজনৈতিক অভিধানে এক গভীর, বহুস্তর অর্থবোধক শব্দ। এর অর্থ শুধু দুঃখিত হওয়া নয়, বরং একধরনের আবেগের আলকেমি- যেখানে মনের রক্তচাপ কমে গিয়ে অনুভূতির পিএইচ লেভেল বদলে যায়, আর ভেতরের কষ্ট যেন শরীরে রং হয়ে ফুটে ওঠে। এটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘নীল দ্বীপের রাজা’ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাগরের নীলতা নয়- এটা খাঁটি রাজনৈতিক নীলতা, যেখানে বেদনা রূপান্তরিত হয় এক নীরব অভিমানী প্রতিবাদের প্রতীকে।


বিএনপি মহাসচিবের এই ‘নীল হয়ে যাওয়া’-এর পেছনে লুকিয়ে আছে দীর্ঘদিনের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এক গভীর অবিচারবোধ। ছাত্র রাজনীতি মানেই তো ত্যাগ, সংগ্রাম, আর হ্যাঁ, চাঁদা... মানে, চাঁদার মাধ্যমে সংগ্রাম! যারা ‘শিক্ষা আন্দোলন’-এর নামে সেমিস্টার ফির সমান চাঁদা তোলে, তাদের গ্রেপ্তার হওয়া সত্যিই হৃদয়বিদারক। এত আত্মত্যাগ, রাত জেগে পোস্টার লেখা, আর ‘চাঁদা না দিলে আন্দোলন চলবে না’ জাতীয় স্লোগান- এসব কি আজ নিষ্ফল? যারা গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে দিনরাত ফান্ড কালেকশন করে আন্দোলনের অক্সিজেন জুগিয়েছেন তাদের যদি এভাবে অপমান করা হয় তবে এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির পথ কোথায়?


মির্জা ফখরুল সাহেব তো জানেন কীভাবে আন্দোলন করতে হয়, কীভাবে টিকে থাকতে হয়, কীভাবে চাঁদা ছাড়া কিছুই চলে না। তিনি রাজপথে হেঁটে হেঁটে এই অনুভব নিজে অর্জন করেছেন। চাঁদা ছাড়া আন্দোলন চলে না, গণতন্ত্র আসে না, মঞ্চ বানানো যায় না, ব্যানার ছাপা হয় না এমনকি কাঁচাবাজারও হয় না। যারা ছাত্র রাজনীতির ব্যানারে বছরের পর বছর ফান্ড কালেকশন করে কাটিয়ে দিয়েছেন, তাদের ‘চাঁদাবাজ’ বলা শুধু অনৈতিক নয়, বরং অগণতান্ত্রিকও। তাই, পাঁচ সমন্বয়ক গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পড়ে তার ‘বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া’ আসলে এক গভীর রাজনৈতিক সৌজন্য ও ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতার প্রকাশ।


চাঁদাবাজির দার্শনিক ভিত্তি: ‘তোমার আছে, আমার নেই- তুমি আমাকে দাও’ চাঁদাবাজিকে মোটেও খারাপ চোখে দেখা যায় না। এর দার্শনিক ভিত্তি খুবই সরল: ‘তোমার আছে, আমার নেই- তুমি আমাকে দাও।’


অনেকেই বলেন, ‘এই ছাত্র রাজনীতি আর আগের মতো নেই।’ কিন্তু ভুল করবেন না। আগেও ছিল চাঁদা, এখনো আছে। আগে ছিল ‘স্বেচ্ছাচাঁদা’, এখন আছে ‘অবশ্য-দেয়া-চাঁদা’। আগে ছিল কথার জোর, এখন আছে চোখের জোর এবং ব্যানারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ‘ভাই’-এর জোর। চাঁদাবাজি এখন এক বিপ্লবী সামাজিক সাম্য- তুমি পুঁজিপতি, আমি নিপীড়িত- তুমি দেবে, আমি নেব। আর যদি না দাও, তবে একটা ‘ব্যবস্থা’ আছে!


চাঁদাবাজির বহুমাত্রিক উপকারিতা রয়েছে। যেমন: ১. বেকারত্ব নিরসনে অবদান: দেশের হাজারো তরুণ-তরুণী আজ কর্মহীন। চাঁদাবাজি তাদের জন্য এক স্বনির্ভর কর্মপদ্ধতি। তারা এখন ‘বিনিয়োগ ছাড়া আয়’ মডেলের পথিকৃৎ। ২. নেতৃত্ব তৈরি: যে সবচেয়ে বেশি চাঁদা তুলতে পারে, সে-ই এলাকার ‘ভাই’। নেতৃত্বের মাপকাঠি এখন ‘কে কত চাঁদা তুলতে পারে’ দিয়ে নির্ধারিত হয়। ৩. আর্থিক প্রবাহ ও তরল অর্থনীতি: চাঁদাবাজি পুঁজিবাদের বিকল্প এক প্রান্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে- একটা ‘পিপলস ইনফরমাল ফান্ড’, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ফেস্টুন, পোস্টার, লাউডস্পিকার ও নেতার সিগারেট। ৪. রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি: চাঁদাবাজি এখন আর এক দলের একক সম্পত্তি নয়- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে করে, বিএনপি ক্ষমতায় না থেকেও করে, জামায়াতেরও তালিকা আছে।


এমন পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় চাঁদাবাজি উন্নয়ন নীতি’ ঘোষণা করা সময়ের দাবি। যেহেতু চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাচ্ছে না, বরং এটি শাখা-প্রশাখার মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তাই একে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে উন্নয়নশীল করা প্রয়োজন। নিচে প্রস্তাবিত নীতিমালা দেয়া হলো:


চাঁদার হার নির্ধারণ: স্কুলছাত্র ৫০০ টাকা, কলেজ ৫০০০ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ১৫০০০ টাকা, আর যাদের দাপট বেশি তারা ইচ্ছামতো।
চাঁদার রশিদ বাধ্যতামূলক: ‘গণতন্ত্র রক্ষায় চাঁদা গ্রহণ করা হলো- তাং: ...’ লিখে রশিদ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিকাশে QR কোড স্ক্যান করেও দেয়া যেতে পারে।
চাঁদাবাজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন: কীভাবে ‘চাঁদা চাইতে হয়’ তার ওপর ডিপ্লোমা কোর্স চালু হতে পারে।


চাঁদা মেলা আয়োজন: যেখানে ‘সব দলের তরুণরা’ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে বলবে-’ চাঁদা দাও, আন্দোলন বাঁচাও।’
চাঁদাবাজি যদি অপরাধ হয়, তাহলে আমরা সকলেই কোনো না কোনো পর্যায়ে অপরাধী। চাঁদাবাজি আত্মসাৎ নয়, বরং আত্মপ্রকাশ-’ আমি আছি’, ‘আমিও চাই’, ‘আমিও নেতা হতে পারি’-এর এক সরব ভাষ্য।


তাই যখন বিএনপি মহাসচিব বেদনায় নীল হন, সেটা শুধুই কাব্যিক নয়- এটি এক রাজনৈতিক শোক প্রকাশ, এক পতাকা অবনত, এক স্বচ্ছ স্যালুট চাঁদাবাজদের প্রতি, যারা আজকের দিনে আমাদের রাজনীতিকে জীবন্ত রেখেছেন।


এখন সময় এসেছে চাঁদাবাজিকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করার। আমরা এতদিন একে দেখেছি ঘৃণার চোখে, ‘অপরাধ’, ‘অপসংস্কৃতি’, ‘সন্ত্রাস’ ইত্যাদি ছাপ দিয়ে একে সামাজিকভাবে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করেছি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে- চাঁদাবাজি এখন আর একক কোনো দলের অভ্যাস নয়, এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ক্ষমতায় থাকুক আওয়ামী লীগ, কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকুক বিএনপি, অথবা মাঝখানে দাঁড়িয়ে ‘বিপ্লব’ আর ‘রাষ্ট্রসংস্কার’-এর কথা বলুক কেউ- চাঁদাবাজি সবার রক্তেই আজ সমানভাবে প্রবহমান।


যারা একসময় বলেছিলেন, ‘আমরা অন্যরকম ছাত্র রাজনীতি করব, অন্যরকম রাজনীতি গড়ব,’ আজ তারাই অন্যরকম স্টাইলে ‘চাঁদা না দিলে প্যাদানি’ মডেল চালু করেছেন। রাষ্ট্র যদি বঞ্চনা করে, তবে আন্দোলনের চাঁদার নামে সাধারণ মানুষকেও একটু বঞ্চনা করার অধিকার কি থাকবে না? এটাই তো সামাজিক সাম্যবাদের বাস্তব চেহারা। তুমি এক প্লেট বিরিয়ানি খাচ্ছ, আমি শুকনো মুড়ি- তাহলে তোমার কাছ থেকে একটা ‘অংশ’ নিয়ে আমি নিজের ভাগ বুঝে নেব, সেটাই ন্যায়সংগত।

লেখক: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ