প্রবাসে অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে বসবাস করা দায়
কোনো দেশের স্বাধীনতার পর সে দেশের জনগণকে শিখতে হয় দেশপ্রেম, নাগরিক দায়িত্ব, মানবিক দায়িত্ব, আত্মনির্ভরশীলতা এবং বিবেকের ব্যবহার। আর আমাদের বাংলাদেশে শেখানো হয়েছে রাজনীতি। যেখানে বর্ণিত সব শব্দই প্রায় অনুপস্থিত। অনুপস্থিত বলেই বিদেশেও দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না। শুধু আমরা নই, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশটাও কলঙ্কিত হচ্ছে। লন্ডন-আমেরিকার মতো এত উন্নত দেশে থেকেও আমাদের অতিমাত্রায় দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা উন্নত রাজনীতির বদলে দেশীয় ও দলীয় অসুস্থ সংস্কৃতি ধরে রাখতে চান বা ধরে রেখেছেন। তাতে কেন জানি আমার খুব কষ্ট হয়। দেশের অসুস্থ রাজনীতির কথা আর কি বলব। এই অসুস্থ রাজনীতির অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের সবারই আছে। সুতরাং আমাদের অতি উৎসাহী ও দেশদরদি প্রবাসী রাজনীতিবিদদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে তারা রাজনীতি করবে ভালো কথা; কিন্তু তা যেন হয় দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে।
দেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মনে না রেখে যেখানে আছেন সেখানকার রাজনৈতিক ভালো অভিজ্ঞতাগুলো যদি কাজে লাগাতে পারেন তবে দেশ ও জাতির অনেকটা উপকারে আসবে। তাছাড়াও নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। আমরা সাধারণ জনগণ তাদের কাছ থেকে ভালো ও উন্নত রাজনীতি কি আশা করতে পারি না, যা দেশ ও জাতির কল্যাণে আসবে? আমরা সবাই গণতন্ত্রের পাগল। সবখানেই এই শব্দটা বার বার মহাগর্বে উচ্চারণ করি; কিন্তু আসলে আমরা কতটুকু পালন বা ভোগ করছি তাই জিজ্ঞাসা। আমার বিশ্বাস রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের অর্থ ও ব্যাখ্যা খুব করেই জানেন এবং বুঝেন; কিন্তু খারাপ লাগে তখনই যখন দেখি তারা জেনেও না জানার ভান করে দলীয় স্বার্থে এটাকে বিসর্জন দেন। তাই তো বলতে হয়, দুঃখ যেখানে গভীর, ভাষা সেখানে নীরব।
সব প্রবাসী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিনীত অনুরোধ, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সব প্রবাসী রাজনৈতিক দলের নেতা ও নেত্রী মহোদয়কে বলছি, আপনারা বিদেশে থেকে দেশের দলীয় অসুস্থ রাজনীতির সংস্কৃতি বিদেশে চালু করে আসছেন তা বন্ধ করতে পারাটাই দেশপ্রেমের বিরাট একটা উদাহরণ হবে। আমরা কেন ভুলে যাই দল থেকে দেশ বড় আর দেশ থেকে জাতি বড়। কেন আমরা নিজের দেশকে অন্য দেশের কাছে ছোট করব। বাঙালিরা তো মাথা নত করতে জানে না, জানে শুধু উঁচু রাখতে আর তাই তো নাম বীর বাঙালি। তবে কি আমরা জেনেশুনে বিষ পান করছি শুধু কর্তাকে খুশি করার জন্য? দেশ ও জাতি এই রাজনীতিবিদদের কাছে ভালো কিছু আশা করা অন্যায় ও পাপ নয় তাও মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
একে অন্যের প্রতি রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িতে আমাদের একটা স্বাধীন দেশ, কেন প্রবাসে এই অপমানের বোঝা সমগ্র জাতিকে সইতে হবে। বিদেশে জাতিকে ছোট করার বোঝা কে বইবে? মনে রাখা দরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কী শিখছে এবং আমরা তাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি। তাই অন্তত তাদের স্বার্থে হলেও সঠিক রাজনীতির চর্চা একান্ত প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, এটা আপনার-আমার সবার দায়িত্বও বটে। সবাই যদি যার যার বিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা করি তাহলে এসবের উত্তর পেয়ে যাব। অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। রাজনীতি করব ভালো কথা, তবে এই রাজনীতি যেন দেশ ও জাতিকে ছোট না করে সে দায়িত্বটিও মাথায় রাখতে হবে। রাজনীতিবিদরা জ্ঞানী-গুণী মানুষ তাই, তারাই ভালো জানবেন বা বুঝবেন দেশের রাজনৈতিক অবকাঠামো। রাজনৈতিক দলের কোনো নেতানেত্রী বা মন্ত্রী পদমর্যাদার আসনে সমাসীন কোনো ব্যক্তি লন্ডন কিংবা আমেরিকা এলেই যেন প্রতিবাদে প্রস্তুতিটা এক ধরনের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতানেত্রীরা এলেও।
শুধু প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ নয় অনেক সময় তা হাতাহাতির পর্যায়ও চলে যায় যা সামাল দিতে লন্ডন আমেরিকার পুলিশকে পর্যন্ত হিমশিম খেতে হয়। রাজনীতিকদের কেউ কেউ বেমালুম ভুলে যান কোথায় আছেন কি করছেন। এখানে যে কোনো দলেরই নেতানেত্রী বা মন্ত্রী এখানে আসেন না কেন ওরা তো আমাদেরই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। ওদের সম্মান করা বা সম্মান জানানো দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করা। এটি কোনো দলের একক স্বার্থ হতে পারে না। প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক ভাষা হলেও তা যেন দেশকে ও জাতিকে ছোট করার পর্যায় না পড়ে। আপনাদের প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে শালীনতাপূর্ণ। অথচ যেভাবে প্রতিবাদ করা হয় তা কোনো রাজনৈতিক অভিধানে এমন প্রতিবাদের ভাষা আছে বলে আমার মনে হয় না। আর প্রবাসে তো নয়ই। দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থে আমরা দেশ ও জাতিকে বিদেশিদের কাছে ছোট বা অপমান করা কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব নয়।
কথায় আছে ‘জীবনে বড় হও, তবে কাউকে ছোট করে নয় ! জীবনে মন খুলে হাসো, তবে কাউকে কাঁদিয়ে নয় ! জীবনে জয়লাভ করো, তবে কাউকে ঠকিয়ে নয়।’ আরও মনে রাখতে হবে ‘মানুষের যতই বন্ধুবান্ধব কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী থাকুক না কেন, বেশিরভাগ সময় জীবনে বা দেশের কঠিনতম মুহূর্তগুলো তাদের একা একাই পার করতে হয়।’ জেনেশুনে রাজনীতিবিদরা যা করছেন এটার নাম কি দেশপ্রেম, এটার নাম কি জনসেবা? সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শতাধিক সদস্যের যে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছায়, সেখানে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন; কিন্তু সবার ভিসার ধরন অভিন্ন না হওয়ায় বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, এনসিপি নেতা আখতার হোসেন ও তাসনিম জারাকে সাধারণ যাত্রীর জন্য নির্ধারিত গেট দিয়ে জেএফকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে হয়।
এ সময় আওয়ামী লীগপন্থি এক দল প্রবাসীর গালাগাল ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাদের। বিশেষত এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের গায়ে ডিম ছোড়া হয়। ঘটনায় জড়িত একজনকে নিউইয়র্ক পুলিশ আটক করেও পরে ছেড়ে দেয়। যাহোক, একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রবেশদ্বারে এই হঠকারিতা একটাই বার্তা দিল; ‘বাংলাদেশি মানেই ঝামেলা।’ গত কয়েক দশকে এটাও স্পষ্ট, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রবাসী শাখাগুলো সেখানকার উচ্চতর রাজনৈতিক সংস্কৃতি আত্মস্থ করার বদলে দেশের সংঘাত সেখানে আমদানি করেছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, দূতাবাস-কনস্যুলেট ঘেরাও, হাতাহাতি যেন নিয়মিত দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। হোস্ট দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও বিষয়গুলো ভালোভাবে নেয়ার কোনো কারণ নেই। সেখানকার সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এসব খবর বিদেশি সমাজের চোখে বাংলাদেশিদের ‘রিস্কি কমিউনিটি’ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। এতে প্রবাসীদের কোনো লাভ নেই; বরং দেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে। এসব কাজে জড়িতরা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে।
এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটেছে সেখানকার বাংলাদেশি দূতাবাস-কনস্যুলেট তার দায় এড়াতে পারে না। তাদের কাজ হওয়ার কথা রাষ্ট্রীয় সফরের আগাম সমন্বয়, বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের সুরক্ষা এবং বিদেশের মাটিতে দেশের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং। বাস্তবে প্রায়ই দেখা যায় বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো অপ্রীতিকর ঘটনার পর বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব সম্পন্ন করে। বিশেষত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রবাসী নেতাকর্মীরা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে আসছেন। বিদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার পর যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি দূতাবাস এবারের ঘটনা এড়াতে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে পারত।
প্রবাসী রাজনীতিকদের হঠকারিতা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় দূতাবাসের ঢিলেঢালা প্রস্তুতির স্বেচ্ছাচারের শিকার হচ্ছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। আমেরিকাসহ শতাধিক দেশে তারা নির্মাণ শ্রমিক, ট্যাক্সিচালক, কৃষি শ্রমিক, শিক্ষার্থী, নার্স, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপকসহ নানা পেশায় নিয়োজিত। তারা আইন মানেন, কর দেন, রেমিট্যান্স পাঠান। আমরা জানি, এত দুর্নীতি ও ক্ষতির পরও যে বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে, তার পেছনে বড় অবদান প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। তাই বিদেশে তারাই রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রতিনিধি। দেশের সুনাম ও আস্থার ভার তাদের কাঁধে; কিন্তু প্রবাসের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো যদি দাঙ্গা-ফ্যাসাদে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে থাকে তাহলে বড় খেসারত দিতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মানসিকতা বোঝাতে বিদেশের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই, ইংল্যান্ডের ট্রেন কিংবা বাসে খুব ব্যস্ত সময়ে প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝেও মানুষগুলো এত সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কারও বিরক্তির কারণ হয় না।
প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় এমনটি দেখে দেখে অভ্যস্ত আমি। স্বপ্ন দেখি, কোনো একদিন আমার দেশেও এমন পরিবেশ গড়ে উঠবে। কেননা, দিনকে দিন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন আসছে; কিন্তু এসব যেন আশায় নিরাশা শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। আমাদের দেশে অপরাধীর শাস্তির উদাহরণ কম, তাই দিনকে দিন অপরাধ বাড়ছে তো বাড়ছেই। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বলতে হয় আপনারা সত্য এবং সঠিক রাজনীতি করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। একই সঙ্গে নিজের মধ্যেও খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। দলকে একমাত্র মুখ্য মনে না করে দেশকে ভালো বাসুন, দেশের মানুষকে ভালো বাসুন। দেশ ও জাতির স্বার্থে সত্য কথাগুলো তুলে ধরুন, তবেই প্রবাসে নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। আর এতেই দেশ ও জাতির মঙ্গল নিহিত।
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক, লন্ডন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে