সারাদিন মর্গ থেকে মর্গে
আজ সারা দিন মর্গে মর্গে ঘুরে তারপর ফিরলাম বাসায়। এই পুরো সময়টায় একবারের জন্যও কোনো সন্তানহারা মা-বাবার দিকে মোবাইল তাক করে একটা প্রশ্ন করারও সাহস হয়নি। মর্গে কয়লার মতো হয়ে যাওয়া শিশুদের ছোট ছোট শরীরগুলো সারি করে রাখা। চোখ ছলছল করেছে, পা টলমল করেছে, গলা ধরে এসেছে। সেসব আবেগ একপাশে সরিয়ে টিম নিয়ে নিউজ প্ল্যান করেছি ঠান্ডা মাথায়; কিন্তু শোকে কাতর বাবা-মা আর নিহতদের স্বজনের সামনে ক্যামেরা তাক করার সাহস হয়নি আমার। এখনকার সাংবাদিকতার এই জায়গায় এসে আমি অকেজো হয়ে উঠছি।
ঢামেকের বার্ন ইউনিটের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনের বুকফাটা আহাজারি, উফ কী বেদনাদায়ক! এক মা বুক চাপড়ে বলছিলেন, আমার ছেলের গায়ে একটা টোকা পড়লে সেই ব্যথা আমার শরীরে এসে লাগে। আজ ওর সমস্ত শরীর, এমনকি চুলটুকুও পুড়ে শেষ। ওর সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে, আমি কিছু করতে পারছি না।
এর মধ্যেই দেখি বাইরে হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড, বের হয়ে দেখি ফটোসেশন চলছে। শতশত ক্যামেরা তাক করে রাখা আছে আমাদের ভাগ্য বিধাতাদের লক্ষ্য করে। শত শত নেতাকর্মী নিয়ে তারা ছুটে এসেছেন শোক প্রকাশ করতে। একবার মনে হলো, এই যে এই পরিস্থিতি, এটা নিয়ে তো আমার মনে অযুত প্রশ্ন। তার উত্তর চাইলে কেবল দিতে পারবেন এই ভাগ্য বিধাতারা। করব নাকি কিছু প্রশ্ন গলা ফাটিয়ে, যতদূর আওয়াজ যায়। পরক্ষণেই আগুনে ঝলসে যাওয়া শিশুটি, যে একা একা নগ্ন দেহে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল, তার মুখটা কল্পনায় চলে এলো। আমার সন্তানের মুখ যেন! শরীরে সেই যন্ত্রণা অনুভব করতে করতে মুখ বন্ধ করে বের হলাম সেখান থেকে।
কুর্মিটোলার মর্গে যখন পৌঁছালাম, তখন বিকেল পড়ে যাচ্ছে। দুটি মেয়ে শিশুর জড়াজড়ি করা দেহ রাখা হয়েছে একই ব্যাগে। স্বজনের খোঁজ মিলেনি তখনো। সকালেই যারা স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে উচ্ছ্বাসে ছুটছিল, এখন তারা অজ্ঞাতনামা। পুলিশ সদস্যরা প্রথমে খুব সহানুভূতি দেখাচ্ছিল, যখন জানল আমি এদের কেউ না, তখন কিছুটা রূঢ়ভাবেই বের হয়ে যেতে বলল। শিশু দুটিকে নেয়া হচ্ছিল সিএমএইচ মর্গে। পুলিশ বলল, ওখানেই গিয়ে খোঁজ নিন, এখানে আর কিছু নেই।
অন্ধকার নামার আগেই গিয়ে দাঁড়ালাম সিএমএইচ-এর মরচুয়ারির সামনে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে একেক পর এক মরদেহ এসে সেখানে জমা হচ্ছে। মরদেহগুলোর গায়ে জেট ফুয়েলের তীব্র গন্ধ। পুরো মরচুয়ারিই যেন ফুয়েল স্টোরেজ! মর্গের এককোণে ভয়ে ভয়ে তাকালাম, সুকান্তের সেই নগণ্য, ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি পড়ে নেইতো আবার? ভয় হলো তারা আবার না ছড়িয়ে পড়ে শহরে, গঞ্জে ও গ্রামে- দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
পাশে ঘরে যে মা মাতম করছেন, তিনি বললেন, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বালানি ছড়িয়ে পড়ে পুরোটা জায়গায়, তাতেই দগ্ধ হয় তার ছেলে। মর্গের দরজার দিকে তাকিয়ে উনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘কুটু, কুটু, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে বাবা’?
সেখান থেকে পালিয়ে পার্কিং লটে এসে দাঁড়ালাম একটু শ্বাস নিব বলে। সেখানেও মাটিতে বসে এক তরুণ আহাজারি করছে, ‘ও মা, যখন আগুন লেগেছে, তখন কি তোমার অনেক যন্ত্রণা হয়েছে, তুমি কি ভয় পেয়েছিলা আমার পুতুল। মাকে খুঁজেছিলা।’ আমার সহকর্মী তরুণটির মাথায় হাত দিয়ে বলল, এই লিওন ভাই, পাগলামি করেন না ভাই, একটু পানি খান। আমাকে বলল, আপা, এটাই লিওন মীর ভাই, উনার ভাগনি মারা গেছে।
এর মধ্যেই শুরু হলো মরদেহ হস্তান্তর। হিসাব কষে, সংখ্যা মিলিয়ে সেই দেহগুলো দেয়া হলো স্বজনের কাছে। এই ছোট্ট শরীরগুলোকে স্বজনরা কীভাবে গোসল দেবেন, কীভাবে কাফনের কাপড় পরাবেন, সেই চিন্তা বেশি দূর এগুলো না।
কান্নাকাটি শব্দ শুনে পাশে তাকাতেই দেখি আরেক ভদ্রলোক এসেছেন স্ত্রীর মরদেহ খুঁজতে। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে মা মারা গেছেন, দগ্ধ ছেলে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। স্বজনরা লোকটিকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল।
আমি ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সেই চলে যাওয়া দেখলাম। ক্যামেরা ব্যাগেই ছিল। হাতে উঠল না। এ দৃশ্য ধারণ করার মতো সাহসী আমি এখনো হয়ে উঠিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে