অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট ভাঙুন, অপরাধীদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করুন
একজন নবজাতক বাবা-মা, পরিবার ও সেই পরিবার ঘিরে অসংখ্য আত্মীয়স্বজনের বহুদিনের স্বপ্ন-ভালোবাসার ফসল। একজন নবজাতক এই পৃথিবীর এক নতুন মানুষ। জন্মের পর পৃথিবীর আলো-বাতাস বুক ভরে ভোগ করার আগেই যদি সেই শিশুটির মৃত্যু হয় তাহলে তার চেয়ে দুঃখের কিছু নেই। আর সেই মৃত্যু যদি হয় কোনো অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে তাহলে বলতেই হয় এর চেয়ে অসভ্যতা আর কিছু নেই।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আমরা জানতে পারলাম, শরীয়তপুরে একটি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় অসুস্থ অবস্থায় এক নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, শরীয়তপুরের অ্যাম্বুলেন্স চালক সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দীর্ঘসময় আটকে থাকায় এই ঘটনা ঘটেছে।
রোগীর স্বজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর এলাকার নূর হোসেন সরদারের স্ত্রী রুমা বেগম সন্তান সম্ভবা ছিলেন। বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) দুপুরে তার প্রসব বেদনা উঠলে স্বজনরা তাকে জেলার নিউ মেট্রো ক্লিনিক নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে তার একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তবে বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই কিছুটা ঠান্ডার সমস্যায় ভুগছিল। পরে শিশুটিকে ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেন হাসপাতালের চিকিৎসক। পরিবারের লোকজন তখন শিশুটিকে ঢাকায় নেয়ার জন্য ঢাকাগামী একটি অ্যাম্বুলেন্স ৫ হাজার টাকায় ভাড়া করেন। পরবর্তীতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলে গাড়িটির গতিরোধ করে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স চালক সবুজ দেওয়ান ও আবু তাহের দেওয়ান নামে দুই ব্যক্তি। তাদের অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় যেতে দিতে রাজি নয় তারা। একপর্যায়ে তারা ঢাকাগামী সেই অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাবি কেড়ে নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে। এ সময় রোগীর লোক বাধা দিলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। এমন অবস্থায় দীর্ঘ ৪০ মিনিট আটকে থাকার পর অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই শিশুটির মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় শুক্রবার রাতে পাঁচজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন শিশুটির বাবা নূর হোসেন।
এ ঘটনায় মামলার প্রধান আসামি সবুজ দেওয়ানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জানিয়েছেন র্যাব-৮ এর মাদারীপুর ক্যাম্পের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মীর মনির হোসেন। ওই মামলার অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য র্যাব ও পুলিশ কাজ করছে। আমরা চাই অবশ্যই অচিরেই অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করতে হবে এবং তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। খুনের দায়ে তাদের অভিযুক্ত করতে হবে। এ ঘটনায় কোনো আসামি যদি ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে তা হবে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। একটি নবজাতকের মৃত্যুর সঙ্গে তা বেইমানি হবে। সেই নবজাতকের পুরো পরিবারের সঙ্গে বেইমানি হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া কোনোভাবেই আমরা সেই নবজাতকের বাবা-মার কাছে আমাদের বিবেকের অপরাধ ঘোচাতে পারব না।
এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট নিয়ে এখনই সরকারকে সচেতন হতে হবে। এরকম ঘটনা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা জেলা শহরে হরহামেশাই দেখা যায়। এক এলাকার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অন্য এলাকার অ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে হাসপাতাল যেতে পারবেন না- এর অর্থ কী? অ্যাম্বুলেন্সও কি টেম্পো স্ট্যান্ডেটের মতো যে নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া চলতে পারবে না? আর যেখানে একটি নবজাতক রোগী আছে সেখানে এমন অমানবিক আচরণ করার সাহস ওই সিন্ডিকেট পায় কী করে? কী তাদের শক্তি? পরিবহন সেক্টরের মতো এসব অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটও কি দখল করে রেখেছে রাজনৈতিক নেতারা? পেছনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া না থাকলে ওই অ্যাম্বুলেন্স চালকদের এতটা সাহস দেখানোর কথা নয়।
আর এ অ্যাম্বুলেন্সগুলোর মান নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আলাপ হচ্ছে। অনেক অ্যাম্বুলেন্সে ঠিক মতো অক্সিজেন সেবা থাকে না বলেও জানা গেছে। ভাঙা-পুরোনো মাইক্রোবাস কিনে অনেকে এসব অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা করেন। অনেক সময় কোনো হাসপাতালের সঙ্গেও তাদের চুক্তি থাকে না। তারা দখল করে রাখে রাস্তা। তাদের অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে রোগী না নিলে তারা নানারকম নাজেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেক অ্যাম্বুলেন্স রোগী না পেলে সাধারণ যাত্রীও বহন করে। এরকম অনেক খবরও ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্স নানারকম অপরাধচক্রের সঙ্গেও জড়িত। অনেক হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা নেই, তখন তারা এসব বহিরাগত অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের ওপর নির্ভর করে যা আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবার আরেক নাজুক দিক।
তাই আর দেরি না করে যেভাবেই হোক এই অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটচক্র ভাঙুন। প্রতিটা অ্যাম্বুলেন্সের যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণে বাধ্যতামূলক আইন করুন। অবশ্যই প্রতিটা অ্যাম্বুলেন্সকে নির্দিষ্ট হাসপাতালের আওতায় থাকতে হবে। স্থায়ীয় প্রশাসনের কাছে তাদের নাম তালিকাভুক্ত হতে হবে। তা না হলে এটা চিকিৎসাসেবায় অরাজকতা বাড়াবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে