নারী ফুটবল দলের প্রতি বৈষম্য দূর করুন
সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৪-০ গোলে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০২৩ সালেও এই শিরোপা অর্জন করেছিল অদম্য মেয়েরা। নারী ফুটবলারদের সাফল্যের গল্প বেশ গৌরবোজ্জ্বল। বয়সভিত্তিক সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে মিয়ানমারে গিয়ে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ সিনিয়র নারী দল; কিন্তু দুঃখজনক খবর হচ্ছে, এত সাফল্যের পরও নারী ফুটবল দল বঞ্চিত। এ প্রশ্ন শুধু ক্রীড়ামোদী মানুষদের নয়, বরং দেশের সব সচেতন মানুষের যে, নারী-পুরুষ খেলোয়াড়দের মধ্যে সমতা আসবে কবে?
আজ শনিবার (২৬ জুলাই) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, একই দেশের পতাকা নিয়ে মাঠে নামে দুই দল। ঘাম ঝরায়, জয়ের জন্য লড়াই করে; কিন্তু তারপরও দুই দলের পথ পুরোপুরি আলাদা। এক দল হাঁটে লাল কার্পেট বিছানো রাস্তায়, অন্য দল কাঁটা বিছানো পথে। বাংলাদেশ পুরুষ ও নারী ফুটবল দল যেন বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। যেখানে পুরুষদের জন্য সুবিধা ও সমর্থনের ছড়াছড়ি। সেই তুলনায় নারীরা পান না বলার মতো তেমন কিছু। নারীদের পথচলা বৈষম্য আর অবহেলার বিরুদ্ধে।
অল্প সময় আর সীমিত সুযোগের পরও বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল পুরুষদের চেয়ে কতটা এগিয়ে গেছে তা পরিসংখ্যানই বলে দেয়। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১০ সালে শুরুর পর ২০২৫ সালের এই জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ নারী দল খেলেছে ফিফা স্বীকৃত ৭০টি ম্যাচ। এর মধ্যে জয় এসেছে ২৮টিতে। জয়ের হার শতকরা ৪০। হার ৩১টি, ড্র ১১টি। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৫ বছরে পুরুষ দল খেলেছে ১২৭টি ফিফা স্বীকৃত ম্যাচ। জয় মাত্র ৩৫টি। শতকরা জয়ের হার ২৭। হার ৬২টি, ড্র ৩০টি।
এত সাফল্যের পরও বেতন কাঠামো থেকে শুরু অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে নারী ফুটবলারদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়। বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবলে লিগ কবে শুরু, শেষ কবে, কোন মাঠে হবে, কখন হবে স্বাধীনতা কাপ, কখন নতুন চ্যালেঞ্জ কাপ- সবই আগেভাগে জানিয়ে দেয় বাফুফে। বর্ষপঞ্জি থাকে। ২০০৭ সাল থেকে চলছে পেশাদার লিগ। সেই থেকে লিগ হয়ে আসছে প্রতি বছরই। আর নারী ফুটবলারদের জন্য কোনো বর্ষপঞ্জিই নেই। কাঠামো নেই। ২০২৪ সালের মে মাসে সর্বশেষ লিগ হওয়ার পর ১৩ মাস পেরিয়ে গেছে। নারীদের জন্য কোনো ঘরোয়া ফুটবল আয়োজন হয়নি। লিগ হয় বছরে একবার, তা-ও খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে। দল আনতে হয় অনুরোধ করে। সর্বশেষ লিগে জাতীয় দলের শীর্ষ ফুটবলাররা কোনো দল পাচ্ছিলেন না।
পারিশ্রমিকেও রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দু-তিন বছর আগেও শীর্ষস্থানীয় পুরুষ ফুটবলাররা ক্লাব থেকে বছরে ৮০-৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছেন। দু-একজন পেয়েছেন কোটি টাকাও। গত বছর ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই অঙ্ক অনেকটা কমেছে। তারপরও সেটা ৪০-৫০ লাখ টাকার ঘরে আছে। বছরের ক্লাব থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকা পাওয়া খেলোয়াড়ের সংখ্যা ১৫-২০ হবে। অন্যদিকে একজন শীর্ষ নারী খেলোয়াড় চার-পাঁচ বছের আগে পেতেন ৪-৫ লাখ টাকা, এখন হয়তো দু-চার লাখ টাকা বেড়েছে। নারীদের বেতন, কোচিং, আবসান সবকিছুতেই ব্যাপক ব্যবধান পুরুষ ফুটবলারদের চেয়ে। অথচ পুরুষ ফুটবলের অর্জনের খাতা যদি হয় বিবর্ণ, নারীদের খাতা অনেক উজ্জ্বল। বাংলাদেশ পুরুষদের জাতীয় দল যেখানে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানে নারী দল অপেক্ষা করেছে আরও ৩৭ বছর। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় সাফ নারী ফুটবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রেখেছে বাংলাদেশ; কিন্তু ছেলেদের চেয়ে অনেক দেরিতে সূচনার পরও নারীরা যা করেছেন তা সোনালি অক্ষরে লেখার মতো।
আমরা চাই নারী ফুটবলারদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুরুষ ফুটবলারদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। সারা বিশ্বেই নারী ফুটবলাররা বৈষম্যের শিকার; কিন্তু বাংলাদেশে এই বৈষম্যের হার খুব বেশি। নারী ফুটবলের বিকাশের জন্য নিয়মিত ঘরোয়া লিগ আয়োজনের বিকল্প নেই। সঙ্গে যোগ করতে হবে কিছু টুর্নামেন্ট। বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা মেয়েদের অনেক দিনের দাবি। নারী কোচ ও সংগঠক তৈরি করাও জরুরি। বাফুফের নেতৃত্বে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ালে নারী ফুটবল গতি পাবে আরও। সামাজিকভাবেও নারী ফুটবলারদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। নারী ফুটবলারদের এই সাফল্য বাংলাদেশের অবহেলিত-বঞ্চিত নারীদেরও সাহস জোগাবে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে