Views Bangladesh Logo

ঈদনির্ভর বাংলা সিনেমা: আশার আলো, না বড় ক্ষতি!

০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দীর্ঘদিন ধরে নতুন বাংলা সিনেমার মুক্তি বন্ধ ছিল। মাঝে শাকিব খানের সিনেমা “দরদ” মুক্তি পেলেও তা বাণিজ্যিকভাবে ততটা সফল হয়নি, যতটা সফল ইদানিং শাকিব খানের সিনেমা হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশে সিনেমা মুক্তি প্রায় বন্ধই ছিল। তবে সর্বশেষ দুই ঈদে মুক্তি পায় মোট ১২টি বাংলা সিনেমা- প্রতিটি ঈদে ছয়টি করে। এর মধ্যে বরবাদ, জংলী, দাগী, তাণ্ডব, উৎসব ও ইনসাফের মতো সিনেমা দর্শক মহলে দারুণ সাড়া ফেলে। সিনেমা হলগুলো হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত; টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে হলের ভেতর- সবখানেই দেখা যায় দর্শকদের উচ্ছ্বাস, উৎসাহ-উদ্দীপনা।

কিন্তু ঈদের পরপরই আবার দেখা গেল সিনেমা হলের সেই পুরোনো চিত্র, কমে গেল সিনেমা হলে দর্শকদের আনাগোনা- সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল নিয়মিত সিনেমা মুক্তির প্রবাহ। বর্তমানে শহরের মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে মাঝে মাঝে কিছু সিনেমা মুক্তি পেলেও জেলা ও থানা শহরের সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোতে চলছে সিনেমা মুক্তির খরা। নতুন সিনেমা না পেয়ে সিনেমা হলগুলো তাদের ব্যবসা নিয়ে গভীর সংকটে পড়ছেন। অন্যদিকে সিনেমা শিল্পের কিছু কিছু শিল্পী ও কলাকুশলী আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ২০২৬ সালের ঈদের সিনেমার প্রস্তুতি নিয়ে।

এই অবস্থাকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, ঈদের সময় সিনেমার প্রতি দর্শকের আগ্রহ আশাব্যঞ্জক, কারণ অনেকদিন পর সিনেমা নিয়ে দর্শকের এই মাতামাতি দেখা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বাংলা সিনেমার ঈদনির্ভরতা আসলে এক অশনিসংকেত। কারণ ঈদ ছাড়া যদি সিনেমা মুক্তি না পায় বা দর্শক সিনেমা হলে না আসে- তাহলে দেশের অধিকাংশ সিঙ্গেল স্ক্রিন হল চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুধু হল নয়, বাংলা সিনেমার বেঁচে থাকাই হয়ে উঠবে সংকটাপন্ন।

এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে গতকাল ২ আগস্ট ২০২৫, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল “গীত ও সংগীত”-এর সাময়িক বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে। সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন চলচ্চিত্রের অভাব ও দর্শক সংকটের কারণে হল দুটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শেষবারের মতো তাদের পর্দায় প্রদর্শিত হয়েছে পূজা চেরী অভিনীত ছবি “টগর”। সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে হয়তো পরবর্তী ঈদে হল দুটি আবার চালু করা হতে পারে। খোদ রাজধানী ঢাকার ভেতরে এভাবে সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়াকে বিপদ সংকেত হিসেবেই দেখা যায় কারণ বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো পুনরায় কার্যক্রম করা ও সংস্কার করার খুব বেশি নজির নেই বাংলাদেশে। ঈদনির্ভর বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাপট নিয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ কথা বলে খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালকদের সঙ্গে। তাদের কারও কণ্ঠে উঠে আসে হতাশা আবার কারও রয়েছে ভিন্নমত।

সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড


এ বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড বলেন, ‘সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তো শুধু ঈদের জন্য হলে চলবে না। ঈদকেন্দ্রিক ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলে, বছরের বাকি সময় এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো কী করবে?’

শাহ আলম কিরণ


আবার চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলেন, ‘ঈদনির্ভরতা অনেকটা আসলে শাকিব খান নির্ভরতা। সারা বছর শাকিব খানের সিনেমা না থাকলে অন্য কোনো নায়ক-নায়িকার সিনেমা দর্শক দেখতে চায় না। ফলে বিনিয়োগকারীরাও ঈদ ছাড়া সিনেমা মুক্তি দিতে আগ্রহী হন না।’

মোস্তাফিজুর রহমান মানিক


চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক মন্তব্য করেন, ‘অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বাংলা সিনেমা বাঁচাতে হলে বছরে ১২টা ঈদ দরকার! আগে ঈদে বড় সিনেমা মুক্তি পেত ঠিকই, তবে বাকি সময়ও নানা সিনেমা মুক্তি পেত এবং সেগুলোরও দর্শক ছিল। এখন যদি শুধু ঈদে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে সিনেমার ব্যবসা টিকবে না।’

বন্ধন বিশ্বাস


পরিচালক বন্ধন বিশ্বাস বলেন, ‘এই সংকট সমন্বয়হীনতার। ভালো গল্প, ভালো সিনেমা, আর দর্শকের আগ্রহ- সব কিছুতেই ঘাটতি আছে। আমরা নির্মাতা, প্রযোজক, পরিবেশক সবাই মিলে এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। এখন অনেক ভালো সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, দর্শকও আসছেন। আমরা শিগগিরই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।’

রাজীবুল হোসেন


অন্যদিকে পরিচালক রাজীবুল হোসেন সমস্যাটিকে দেখেন ভিন্নভাবে। তিনি মনে করেন, ‘সমস্যাটা মূলত নীতিগত। আমাদের ‘জাতীয় চলচ্চিত্র’ কী হতে পারে- সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। পরিচালকরা অন্য দেশের সংস্কৃতিমূলক চলচ্চিত্র দেখে অনুকরণ করতে গিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা হারাচ্ছেন। যতদিন না আমরা আমাদের জাতীয় চলচ্চিত্রের চরিত্র নির্ধারণ করতে পারছি ততদিন এসব সমস্যা চলতেই থাকবে।’

শাহীন কবির টুটুল


আবার চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির নবনির্বাচিত মহাসচিব শাহীন কবির টুটুল ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করে বলেন, ‘এটাই বাংলা সিনেমার সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সোনালি অধ্যায়। দর্শক এখন প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা ভালো সিনেমা দেখতে চায়। বিনিয়োগ এখন অনেক বেশি নিরাপদ, কারণ সেন্সরের বাইরেও সিনেমা ওটিটিতে বিক্রির সুযোগ এসেছে। একই সঙ্গে আমরা বহির্বিশ্বেও সিনেমা রিলিজ দিতে পারছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে হলে সিনেমার কোনো বিকল্প নেই। ঈদে নির্মিত সিনেমাগুলোকে ঈদের বাইরেও রিলিজ দিয়ে দেখা উচিত। যেমন হাওয়া সিনেমা কিন্তু ঈদ ছাড়া মুক্তি পেয়েও ব্যবসাসফল হয়েছে। এখনকার প্রযোজকরা শুধুই ঈদের দিকে ঝুঁকছেন; কিন্তু ভালো সিনেমা হলে দর্শক দেখবেই তা ঈদে হোক বা ঈদের বাইরে।’

ঈদনির্ভর বাংলা সিনেমা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, “গীত ও সংগীত” সিনেমা হলের সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। দ্রুত ঈদের বাইরেও সিনেমা মুক্তির ধারা না চালু করতে পারলে, সিঙ্গেল স্ক্রিন হল হারানোর পাশাপাশি বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎও এক গভীর সংকটে পড়ে যেতে পারে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ