Views Bangladesh Logo

ডাকসু নির্বাচন: গণতন্ত্রের পথে আশা, বাধা ও সম্ভাবনা

Rahman  Mridha

রহমান মৃধা

ণতন্ত্রের অনুশীলনকে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হয়, তবে তার সূচনা হওয়া উচিত শিক্ষাঙ্গন থেকে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু বলা হয়, সেখানে ছাত্রসংগঠনের স্বাধীন নির্বাচন গণতান্ত্রিক চর্চার প্রথম পরীক্ষাগার। এবারের ডাকসু নির্বাচন অনেকেই মনে করেছিলেন একটি নতুন সূচনা হতে পারবে; কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এখানেও বাধা এসেছে।

আমি খতিয়ে দেখেছি- কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের নিজ এলাকার ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ফোন করে চাপ দিতে চেষ্টা করেছেন। কেউ হয়তো সেটিকে উপেক্ষা করেছে, কেউ আবার ভয় পেয়েছে। প্রশ্ন হলো, এভাবেই কি আমরা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চাই?

তবুও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। বারবার দমন-পীড়নের পরও কেন শিবিরের মতো একটি সংগঠন শিক্ষার্থীদের মাঝে এখনো আকর্ষণ সৃষ্টি করে? গত ৫৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটিই শেখার বিষয়- দমন কখনোই কোনো আদর্শকে মুছে ফেলতে পারে না। বরং দমন যত বেশি, তার প্রতিক্রিয়া সমাজে তত গভীরভাবে থেকে যায়। এখান থেকে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। গণতন্ত্রে সমান সুযোগ মানে হলো শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে, কারো কণ্ঠ রুদ্ধ করা মানেই তাকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করা নয়। বলপ্রয়োগ করে কাউকে হারানো যায় না, বরং যুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয় কোন পথ সঠিক। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি গণতান্ত্রিক অনুশীলন ব্যাহত হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ আশা করা বৃথা।

এখন প্রশ্ন আসে- ভালো আর মন্দের পার্থক্য কীভাবে নির্ধারণ করব? ভালো হলো যেখানে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও আলোচনার সুযোগ থাকে। আর মন্দ হলো যেখানে চাপ, প্রভাব, অর্থ আর ভয়ভীতি প্রাধান্য পায়। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য হলো, ভালোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং মন্দকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়া।

ডাকসু নির্বাচন গতকাল সম্পন্ন হয়েছে এবং আজ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলাফল এবং অভিজ্ঞতা থেকেই জাতির জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। যদি ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা বাড়বে এবং জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কেও জনগণের মনে নতুন করে আশা জাগবে; কিন্তু এখানে মৌলিক প্রশ্ন উঠতে বাধ্য- আমরা যাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলছি, বাস্তবে কি সেটি সত্য? যদি সত্য হয়, তাহলে কেন একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গনের নির্বাচন সম্পন্ন করতে এত বিশাল প্রশাসনিক বাহিনী মোতায়েন করতে হয়? কেন নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি না? কেন প্রতিপক্ষ ডাকসু নির্বাচন বর্জন করলো? কেন ভোটের ফলাফল দিতে এত সময় লাগল? ভোট কারচুপির এত অভিযোগ কেন?

আমরা যদি দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডাকসু নির্বাচনও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারি, তাহলে ১৮ কোটি মানুষের জন্য যে গণতন্ত্রের চর্চার স্বপ্ন দেখাচ্ছি, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত? অন্যদিকে, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হত্যা, লুটপাট, হামলার মতো অপ্রিয় সত্যগুলোকে সুন্দর ইংরেজি শব্দে ‘মব অ্যাকশন’ বলে চালিয়ে দিলে বাস্তবতা কি পাল্টে যায়? যদি রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ হয় ভয় দেখানো আর শক্তি প্রদর্শন, তবে সহজ, সঠিক এবং সরল পথে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আদৌ কি সম্ভব?

এই প্রশ্নগুলো আমাদের নৈতিক চেতনার দ্বার খুলে দিক। এটিই হবে জনগণের শেখার সুযোগ- ‘লিসন অ্যান্ড লার্ন’। কারণ রাজনীতি করা আর রাজনীতি করতে চাওয়া দুটি আলাদা জিনিস; আবার দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হয়ে রাজনীতি করাও একেবারেই ভিন্ন জিনিস। এই ভিন্ন জিনিসগুলো রাষ্ট্র থেকে একে একে দূর করতে হবে- এখনই।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন- এত বড় দুর্নীতি এত অল্প সময়ে কীভাবে রোধ করা সম্ভব? আমি বলবো, অসম্ভব নয়। টুইন টাওয়ার ধ্বংস মুহূর্তেই ঘটেছিল। শেখ হাসিনার পতনও ঘটেছে হঠাৎ করেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মৃত্যু কখনোই পূর্বঘোষণা দিয়ে আসে না। তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থার শুদ্ধিকরণ কি অসম্ভব? না, মোটেও নয়। যখন দুর্নীতি করা সম্ভব হয়েছে, তখন তা বন্ধ করাও সম্ভব- প্রয়োজন কেবল দৃঢ় সংকল্প আর সঠিক সিদ্ধান্ত।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও আমাদের শেখায়। ভারত বারবার ছাত্র রাজনীতিকে গণতন্ত্রের প্রস্তুতিমূলক অনুশীলন হিসেবে ব্যবহার করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের মতো দেশে ছাত্রআন্দোলন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি হয়েছে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়শই গণতন্ত্র ও সংস্কারের সূতিকাগার। বাংলাদেশের ডাকসু নির্বাচনও সেই ধারাবাহিকতার অংশ হতে পারে, যদি এটি সুষ্ঠু হয়।

সবশেষে একটি আহ্বান- গণতন্ত্র হোক কেবল মুখের বুলি নয়, জীবনের বাস্তব অনুশীলন। প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বাস্তব অনুশীলনগুলো কী কখনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়েছে? তাহলে আছে কি কোনো অনুসারী, যাদের পথ অনুসরণ করব? বাংলাদেশে নেই, কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে আছে। তাই আমি বলবো: চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।

রহমান মৃধা: গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ