Views Bangladesh Logo

ড. ইউনূসের ভাষণ: উচ্চাশা নাকি আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি?

জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে যেভাবে উচ্চাভিলাষী রূপরেখা উপস্থাপন করলেন, তা শুনে প্রথমত মনে হতে পারে- এই সরকার সত্যিই কিছু পরিবর্তন করতে চায়; কিন্তু এই উচ্চাশার রঙিন বয়ানের পরপরই মনে পড়ে যায়- আমরা তো এরকম কথা বহুবার শুনেছি। বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন মুখ আর বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা এই জাতিকে বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নতুন সূচনার ডাক দিয়েছে, আবার নিজেদের সুবিধামতো সেই সূচনাকেই অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতায় ভর করে আজকের ভাষণ শুনে দেশের মানুষ আশাবাদী হওয়ার বদলে সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রশ্ন জাগে- এ কি আবারও সেই পুরোনো খেলা, কেবল মুখপাত্রটা বদলে গেছে?


একটি বছর পেরিয়ে গেল। এই এক বছরে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে কেমন পরিবর্তন এসেছে- তার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় ভাষণের বাস্তবতা। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব, ওষুধের সংকট, স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য, জ্বালানি খাতে ঘাটতি, দুর্বল অবকাঠামো- সবই আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টার উন্নয়নের আশ্বাস জনগণের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে?


ভাষণে বিচারব্যবস্থা সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু ন্যায়বিচার এখনো শুধু ধনীদের জন্য সংরক্ষিত বাস্তবতা হয়ে আছে। মামলার জট বেড়েছে, উচ্চ আদালতের রায় নিচে পৌঁছায় না, আর ‘ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না’- এটা এখনো আমজনতার নিয়তি। দুর্নীতি দমন কমিশন নিজের অস্তিত্বই প্রমাণ করতে ব্যর্থ। যখন সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বড় বড় দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েও নির্বিঘ্নে বিদেশ সফর করেন, তখন জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে- এই শুদ্ধি অভিযান কি কেবল ছোট কর্মচারীদের জন্য?


জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্রের এক নতুন জাগরণ, যা 'জুলাই সনদ'-এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার কথা ছিল। এই সনদটি জনগণের মাঝে এক গভীর আশার সঞ্চার করেছিল যে, স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের কবল থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুসংগঠিত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে; কিন্তু আজকের বাস্তবতা সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। 'জুলাই চেতনা' এখন যেন এক ছন্নছাড়া, বিক্ষিপ্ত এবং অসংগঠিত শাসন কাঠামোর হতাশাজনক প্রতীক হয়ে উঠেছে।


৫ আগস্টের কেন্দ্রীয় সমাবেশে সরকারি অর্থে প্রায় ৬৭৬ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ট্রেনে মাত্র ১৭ জন 'জুলাই যোদ্ধাকে' আনা হয়েছে- এই ঘটনাটি কি মানুষের প্রত্যাশিত পরিবর্তনের চিত্র? গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনাকে এমন তুচ্ছ ও দায়সারাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। আরও বিস্ময়কর হলো, যে এনসিপি (ন্যাশনাল কনসিলিয়েশন প্রোগ্রাম) নিজেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের 'সোল এজেন্ট' হিসেবে দাবি করে, তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতা রাজধানীর মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে কেন ঢাকার বাইরে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন- এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। নেতৃত্বের এমন অনুপস্থিতি কেবল সন্দেহের জন্ম দেয় না, বরং 'জুলাই চেতনার প্রতি তাদের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।


এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, 'জুলাই চেতনা' এখন হয়তো শুধু নির্বাচনি পোস্টার বা মুখের কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এটি আর জনগণের জীবন ও শাসনের বাস্তবতায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থান যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, সেই আদর্শের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কার্যধারার একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। জনগণ প্রশ্ন করতে শুরু করেছে: যে পরিবর্তন তারা চেয়েছিল, তা কি কেবল ক্ষমতা বদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ? নাকি একটি প্রকৃত পরিবর্তন, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে? এই মুহূর্তে 'জুলাই চেতনা' যেন এক পলাতক বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করছে, যা অঙ্গীকার ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেকার বিশাল ফারাককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।


ড. ইউনূস তার ভাষণে জাতীয় সংলাপ, অংশগ্রহণমূলক সরকার এবং আন্তর্জাতিক আস্থার কথা বলেছেন; কিন্তু সংলাপের সংজ্ঞা কি শুধুই কাগজে-কলমে কিছু দলকে ডেকে আলাপ করা? সেই আলাপে যারা যোগ দিয়েছে, তাদের বক্তব্য, আপত্তি ও দাবি কি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে? সংলাপে না থাকা বা ডাক না পাওয়া দলগুলোর প্রতিনিধি কি সত্যিকার অর্থে বাদ পড়ে গেল? সংলাপ যদি প্রকৃত অর্থেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না করে, তবে তা একটি রাজনৈতিক অভিনয় ছাড়া কিছুই নয়। সংলাপের সার্বিক কাঠামো, অংশগ্রহণ, ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা একান্তই যুক্তিসংগত।


‘জুলাই সনদ’তে থাকা অর্থনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান- সবই মহৎ শিরোনাম; কিন্তু প্রতিটি প্রতিশ্রুতির ভেতরে যদি বাস্তবায়নের রূপরেখা, সময়সীমা, এবং জবাবদিহির কাঠামো না থাকে- তবে তা হয়ে পড়ে সস্তা প্রতারণার দলিল। আমরা অতীতে অনেক সনদ দেখেছি, যার মধ্যে ছিল উন্নয়ন, শান্তি ও প্রগতির কথা; কিন্তু সেসব সনদ রয়ে গেছে সংরক্ষণাগারে, আর বাস্তবে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনে ব্যস্ত থেকেছে। সুতরাং 'জুলাই সনদ'কে শুধু উচ্চাভিলাষী বক্তৃতার ফসল বললে কি খুব বেশি অন্যায় হবে?


মানুষ এখন এমন এক ক্লান্তির মধ্যে আছে, যেখানে তারা প্রতিশ্রুতি নয়, প্রমাণ চায়। মাঠে চায় পরিবর্তনের ছোঁয়া, প্রশাসনে চায় স্বচ্ছতা, বিচারব্যবস্থায় চায় বিশ্বাস, এবং অর্থনীতিতে চায় নিরাপত্তা। যারা সরকারের দায়িত্বে আছেন, তারা এই চাওয়াগুলোকে যদি কেবল ভাষণের অলঙ্কারে ঢেকে দেন, তাহলে তাদের ওপর থেকে আস্থা প্রত্যাহার করাই জনতার ন্যায্য প্রতিক্রিয়া হবে। উচ্চাশার খসড়া অনেকেই তৈরি করতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ।


এই মুহূর্তে জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সরকার সত্যিই কি কোনো ভিন্নতা সৃষ্টি করতে পারছে? এই ভিন্নতা কেবল আগের শাসকদের চেয়ে নীতিগত পার্থক্য তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জনগণের জীবনে বাস্তব সুফল বয়ে আনার মাধ্যমেই যাচাই হবে। যদি সরকার জনগণের চাহিদা, হতাশা ও ক্ষোভকে অগ্রাহ্য করে কেবল রাজনৈতিক ভাষণের ভেলায় ভেসে চলে, তবে এই সুযোগও হারিয়ে যাবে। আর একবার যদি জনগণের আস্থা শেষবারের মতো ভেঙে পড়ে, তবে শাসনের নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগবে না।


ড. ইউনূসের ভাষণ এমন একটি সময় এসেছে, যখন জাতি বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, এবং বিভক্ত। এই ভাষণ আশাবাদের বীজ বপন করতে পারত, যদি গত এক বছরে অন্তত একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপিত হতো, যা এই উচ্চাশাকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিত; কিন্তু যখন সেই ভিত্তি নেই, তখন এই ভাষণ একটি বিমূর্ত রাজনৈতিক চিত্রকল্প হয়েই থেকে যায়, যার বাস্তব প্রভাব শূন্যের কোঠায়।


তবুও সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এই সরকার যদি সত্যিই জনগণের রাষ্ট্র গড়তে চায়, তাহলে তাদের কাজ করতে হবে মাঠে-ময়দানে, মানুষের জীবনে। বক্তৃতা দিয়ে নয়, বরং বাস্তব পরিবর্তনের দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তারা ব্যতিক্রমী। নইলে এই ভাষণ ইতিহাসের পাতায় আরেকটি পুনরাবৃত্ত আশ্বাস হিসেবেই সংরক্ষিত থাকবে- যেখানে উচ্চাশা ছিল; কিন্তু বাস্তবতার বালুকাবেলায় তা ডুবে গিয়েছিল নীরবে।


চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ