এনসিপির ৫ নেতা কি দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন?
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে গত ৫ আগস্ট জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির পাঁচ নেতার কক্সবাজার সফর নিয়ে যে বিতর্ক ও রহস্যের জন্ম হয়েছে তাতে ভাঙনের গন্ধ পাচ্ছেন কেউ কেউ। সদ্য গঠিত এই দলটি এখনো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পায়নি। সরকার ঘোষিত সময় অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সুতরাং মাঝখানে আর মাত্র ৬ মাস বাকি। এই সময়ের মধ্যে নিবন্ধিত হয়ে সারা দেশে দল গোছানো এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো বড় দলের সঙ্গে তাদের লড়াই করা কতটা সম্ভব- সে প্রশ্নও আছে। বিচার, সংস্কার ও জুলাই সনদ ইস্যুতে প্রত্যাশা পূরণ না হলে এনসিপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কি না এবং অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের এই দলটি জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলে তার ইমপ্যাক্ট কী হবে, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বিতর্ক শুরু হয়েছে কয়েকটি কারণে:
১. অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে এনসিপির ওই পাঁচ নেতা রাজধানীতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অনুষ্ঠান রেখে কক্সবাজার সফরে গিয়েছেন।
২. এই সফর নিয়ে তারা একধরনের ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ বা গোপনীয়তা বজায় রেখেছেন।
৩. এই সফর নিয়ে দলের দুয়েকজন শীর্ষ নেতা প্রথমে গণমাধ্যমকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, পরবর্তীতে দলের পক্ষ থেকে পাওয়া কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবের সঙ্গে তার অমিল রয়েছে।
৪. তারা কক্সবাজারে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে শুরুতে বলা হলেও এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ পিটার হাসের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ যেমন কেউ এখনো দিতে পারেননি, তেমনি বৈঠক যে হয়নি, সেটিও নিশ্চিত করে কেউ বলছেন না।
৫. পিটার হাস না হলেও অন্য কোনো বিদেশি কূটনীতিক বা কোনো বিদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে তারা বৈঠক করেছেন কি না, সেটিও নিশ্চিত নয়।
প্রসঙ্গত, পিটার হাস বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানিতে যুক্ত মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির কৌশলগত উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত। এর আগে তিনি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৭তম রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
গণমাধ্যমে খবর বলছে, গত ৫ আগস্ট সকালে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ সংগঠক সারজিস আলম ও তার স্ত্রী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং তার স্বামী এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ কক্সবাজারে যান। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সিসিটিভির ফুটেজও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ঘটনার দিন এনসিপির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনে বলেছিলেন, তারা নিতান্তই অবকাশযাপনের জন্য কক্সবাজারে এসেছেন; কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে হাসনাত, সারজিস ও পাটওয়ারীসহ কক্সবাজারে যাওয়া ৫ নেতাকে শোকজ করে এনসিপি। দলকে না জানিয়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে কক্সবাজারে যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
কিন্তু সশরীরে উপস্থিত না হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চিঠির জবাব দেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি লিখেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের অনুষ্ঠানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন, শহীদ ও আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা বা মতামত প্রাধান্য পাওয়ায় তিনি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনবোধ করেননি। তার ভাষায়, অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি নীরব প্রতিবাদ জানাতেই তিনি কক্সবাজারে গিয়েছিলেন। হাসনাত অভিযোগ করেন, বিমানবন্দর থেকে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ও ভিডিও করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও ফেসবুকে জবাব দিয়েছেন। লিখেছেন, সাগর পাড়ে বসে তিনি দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে চেয়েছেন। তিনি এটিকে কোনো অপরাধ মনে করেন না। বরং তার ভাষায়, একজন রাজনৈতিক কর্মীর জন্য এটি একটি দায়িত্বশীল মানসিক চর্চা।
তার দাবি, ৪ আগস্ট রাতে দলীয় কার্যালয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা করে তিনি কক্সবাজার ভ্রমণের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। ঘুরতে যাওয়া অপরাধ নয়-উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ইতিহাস কেবল বৈঠকে নয়, অনেক সময় নির্জন চিন্তার ঘরে বা সাগর পাড়েও জন্ম নেয়।
প্রশ্ন হলো, একটি বিরাট অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থেকে তারা যে ইতিহাস নির্মাণ করেছেন, এরপর আর কোনো ইতিহাস জন্ম দেয়ার জন্য জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে কক্সবাজারে একটি ‘রহস্যজনক’ ভ্রমণে গেলেন? এটি নিতান্তই একটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সফর হলে তারা বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করতেন না। কারণ এনসিপির নেতারা যেখানেই যান না কেন, সেটি দেশের মানুষ আগেভাগেই জেনে যায়। তাছাড়া অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দিনে তাদের অনুপস্থিতি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেননা জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদের ইস্যুতে তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।
হাসনাত বলেছেন, ঘোষণাপত্রের প্রতিবাদ। যদি তাই হয় তাহলে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়েই এই অনুষ্ঠান বর্জন করে কক্সবাজারে যেতে পারতেন। সেটি না করে তিনি ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন শোকজের জবাবে। এমনকি ৫ আগস্টও তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সফরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ বা রহস্যের জন্ম হতো না, যদি বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা না হতো।
এটি ব্যক্তিগত সফর হলে এবং বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরে কোনো প্রশ্ন না থাকলে তাদের শোকজ করা হতো না। বরং বিষয়টি নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠলো, একাধিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলো, তখনই এনসিপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হলো যে, তারা ব্যক্তিগত সফরে গেছেন; কিন্তু এনসিপির তরফে এরকম কোনো বিবৃতি আসেনি। তার মানে এই সফরের বিষয়ে দলের শীর্ষ দুই নেতা অবগত ছিলেন না অথবা তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়েছে।
যদি জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতিবাদ হিসেবেই তারা অনুষ্ঠান বর্জন করেন তাহলে এটি স্পষ্টতই দলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ। কেননা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সুতরাং দলের শীর্ষ নেতা যে অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি, সেই অনুষ্ঠান যারা বর্জন করলেন তারা কি দলের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করলেন? উপরন্তু দল তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের সামনে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলেছিল; কিন্তু সেটি না করে নোটিশের জবাব সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও হাসনাত আব্দুল্লাহ। তার মানে এখানেও তারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করলেন?
এসব কারণে প্রশ্ন উঠছে এনসিপি ভেঙে যাচ্ছে কি না? যে পাঁচজনকে শোকজ করা হয়েছে তারা সবাই দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। শুধু তাই নয়, হাসনাত ও সারজিস এনসিপির আইকনিক নেতা- যাদের নাম নাহিদ ও আখতারের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়। সুতরাং এই পর্যায়ের নেতারা সত্যিই দল থেকে চলে গেলে সেটি এনসিপিকে যে ভীষণ দুর্বল করে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত দলটি ছয় মাসের মধ্যে ভেঙে গেলে আরও অনেক প্রশ্ন জন্ম নেবে।
এসব বাস্তবতায় কক্সবাজার সফরে যাওয়া নেতাদের সমালোচনার মুখে শোকজ করা হলো কি না, সে প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। তবে নোটিশের জবাব দেয়ার পর এ বিষয়ে এখনো এনসিপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এর আগে দলের আরেক শীর্ষ নেতা সারোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে নারী নিগ্রহের অভিযোগ উঠলে তাকে শোকজ করা হয়েছিল। তুষার তার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি কিছুদিন দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত ছিলেন। পরে আবার সক্রিয় হয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজার সফরে গিয়ে শোকজ পাওয়া পাঁচ নেতাও কিছুদিন পর আবার দলে সক্রিয় হবেন কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে