Views Bangladesh Logo

আন্দোলনের শহর ঢাকা

প্রতিদিনের ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ নগরবাসী

তিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, ঢাকা বরাবরই রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে শুরু করে ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান কিংবা ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন- প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে ঢাকা ছিল দৃঢ়ভাবে সোচ্চার। তবে স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও আজকের ঢাকা যেন আরও বেশি ‘আন্দোলনের শহর’ হয়ে উঠেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে রাজধানীতে যেন আন্দোলনের ঢেউ থামছেই না। গণতন্ত্রের চর্চা এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হওয়া এসব আন্দোলন একদিকে যেমন জনগণের দাবি আদায়ের পথ তৈরি করছে, অন্যদিকে তেমনি প্রতিদিনের জনজীবনে সৃষ্টি করছে তীব্র ভোগান্তি। এ ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ তো রয়েছেই।

গত ৯ মাসে রাজধানীতে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত সাড়ে ৩০০টি গণজমায়েত হয়েছে। এসব আন্দোলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রিকশা চালকদের আন্দোলন, অডিট অফিসারদের গ্রেড ও বেতন কাঠামো সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি, আনসারদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন, অধস্তন পুলিশ কর্মকর্তাদের আন্দোলন, রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর বিক্ষোভ, মাদ্রাসা শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতনের দাবি ইত্যাদি।

এ ছাড়াও রয়েছে সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনা ঘেরাও, কোর্টের রায়ে মেয়র পদে ইশরাক আহমেদকে মেয়র ঘোষণা না করায় সিটি করপোরেশন ঘেরাও, জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারের মুক্তিতে সমাবেশ, ছাত্রদলের তারুণ্য সমাবেশ।

অধিকাংশ আন্দোলনকারী দাবি করছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার। ফলে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। আন্দোলনকারীরা কখনো নির্দিষ্ট ব্যানারে, কখনো ব্যানার ছাড়াই নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে অবস্থান নেন- ফলে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট, এ ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ভোগান্তির মাত্রা আরও যোগ করেছে অসহনীয় গরম। তাছাড়া স্বস্তির মেট্রোরেলেও এসব দিনগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়।

বেসরকারি চাকরিজীবী পাভেল চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকায় কোথাও যেতে হলে এখন কমপক্ষে তিন থেকে চার ঘণ্টা হাতে নিয়েই বের হতে হয়। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এটাও যথেষ্ট নয়। ভাবছি পাঁচ ঘণ্টা আগে বের হবো।’

শুধু চাকরিজীবী নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, এমনকি রোগীরাও। অফিসযাত্রী শাহ জামিল জানান, ‘ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে সেদিন আমি মেট্রোরেলে সচিবালয়ে এসে রিকশা নেই; কিন্তু আন্দোলনের কারণে রিকশা চলছিল না। আধাঘণ্টা বসে থেকে শেষে হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হই।’

এদিকে ব্যবসায়ী মো. একরামুল করিম বলেন, ‘এই শহর এখন আর বসবাসযোগ্য নয়। সপ্তাহে তিন-চার দিন রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকতে হয়। সময়মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারি না, এতে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন। এটা কোনো জীবন হতে পারে না।’

ঢাকার এই আন্দোলনপ্রবণতা সাধারণ মানুষের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলছে, তা নিয়েও রয়েছে স্পষ্ট অসন্তোষ। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে নগরবাসীর মধ্যে। অনেকে বলছেন, আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকলেও, সেগুলোর প্রয়োগ যেভাবে করা হচ্ছে- তা জনজীবনে স্থবিরতা এনে দিচ্ছে।

সড়ক অবরোধ কিংবা রাস্তায় টানা অবস্থান কর্মসূচি এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে শুধু অফিসগামী মানুষ নয়, চিকিৎসা নিতে আসা রোগী, পরীক্ষার জন্য ছুটে চলা শিক্ষার্থী কিংবা ঘরে ফেরা শ্রমজীবী মানুষ- সবাই কোনো না কোনোভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছেন।

নোয়াখালী থেকে অসুস্থ মাকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে আসেন ইব্রাহিম। ঢাকায় ঢুকতে যে সময় লেগেছে, তার থেকে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়েছে রাজধানীর যানজটেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য মাকে ঢাকায় এনেছি। এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা সবাই বলেন, প্রশাসন এবং সরকার মানুষের ভোগান্তি নিরসনে আন্তরিক। তবে একসঙ্গে একই সময়ে এতগুলো আন্দোলন চলায়, রাস্তায় যানজট কমানো সম্ভব হয়ে উঠছে না।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু নানা আন্দোলনের নামে সড়ক আটকে যে কৃত্রিম ভোগান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা আয়ত্তে আনার চেষ্টা রয়েছে পুলিশের। অতিরিক্ত জনসমাগম হলে বিকল্প পথে কীভাবে মানুষ গন্তব্যে যেতে পারে সেটা আমরা ভাবছি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ