স্বাধীনতার শেষ প্রহর
ঢাকা অবরুদ্ধ, যৌথবাহিনীর অগ্রযাত্রায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ঠিক চার দিন আগে বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্র সর্বোচ্চ উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। চারদিক থেকে ঢাকা ঘিরে আসে ভারত–বাংলাদেশ যৌথবাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে; দেশের অধিকাংশ এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যত নিশ্চিত—এ ছিল বিজয়ের ঠিক আগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকা অভিমুখে একযোগে অগ্রসর হতে থাকে যৌথবাহিনী। উত্তরে টঙ্গী–গাজীপুর সেক্টর, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ–নরসিংদী অগ্রযাত্রা, পশ্চিমে সাভার ও মানিকগঞ্জ করিডর। এই তিন দিকের অগ্রগতি দ্রুতগতিতে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পাকিস্তানি বাহিনীর স্থল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় প্রায় পুরোপুরি।
১২ ডিসেম্বর সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে আকাশ পথে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর টানা হামলায় তেজগাঁও বিমানবন্দর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক রসদ পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন ব্যারাক ও স্থাপনায় গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংসাত্মক গেরিলা আক্রমণও একই দিনে চূড়ান্ত মাত্রা পায়, যার ফলে শত্রুর চলাচল ব্যাপকভাবে সীমিত হয়।
দেশের অধিকাংশ জেলা এই দিনে মুক্ত হয়। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ—একটির পর একটি অঞ্চল পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মুক্তাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা। মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পতাকা উড়তে থাকে ঘরে ঘরে। “স্বাধীনতা আসছে” — এমন ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। জনসমর্থন মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
এদিন বিশ্ব গণমাধ্যম প্রথমবার প্রকাশ করে—
“ঢাকা ফ্যালস ইমিনেন্ট”—ঢাকা পতন নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হয়ে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ভারত এটিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখতে থাকে। আন্তর্জাতিক সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে আরও দৃঢ় হতে থাকে। ঢাকার অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সামরিক নেতৃত্ব এদিন চরম দ্বন্দ্বে পড়ে। সরঞ্জাম ও খাদ্য সংকটে পড়ে পাকিস্তানিরা। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। সর্বোপরি মনোবলে ভেঙে যায় তাদের।
সব মিলিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর পরাজয় ছিল নিশ্চিত, কিন্তু ১২ ডিসেম্বর তারা এখনো আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এ দিনের বিভিন্ন ঘটনাবলি পরবর্তী চার দিনের বিজয় প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে। ১২ ডিসেম্বরের সামরিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি ছিল সরাসরি ১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণের ভিত্তি।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১—একটি দিন যা স্বাধীনতার বহুল প্রত্যাশিত ভোরকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। ঢাকা ছিল কার্যত পতনের দ্বারপ্রান্তে, আর মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ অগ্রযাত্রায় বিজয় ছিল নিশ্চিত বাস্তবতা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে