Views Bangladesh Logo

ঢাকা বিমানবন্দরের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান থেকে পিছিয়ে

M A Rashid  Tipu

এম এ রশিদ টিপু

য়ারপোর্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যেখানে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক যাত্রী, কর্মচারী ও বিমান পরিচালনা কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এখানে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহৃত হয়, যা অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। তাই একটি কার্যকর ও সুসংগঠিত অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আমাদের আন্তর্জাতিক হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যে সকল ফায়ারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে সেগুলো আন্তর্জাতিক মান থেকে অনেক পিছিয়ে।

এখানে কোনো দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ডিজাইন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমি আজ থেকে তিন বছর আগে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে একটা চিঠি ইস্যু করার জন্য। আদৌ সেটা করা হয়েছে কি না আমি জানি না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের আগে থেকে সচেতন হওয়া উচিত ছিল, যদি আগে থেকে তারা সচেতন হতো, পদক্ষেপ নিত এবং দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কনসালট্যান্ট দ্বারা প্রকল্পিতভাবে ফায়ার ডিটেকশন প্রটেকশন সিস্টেম ও অগ্নি নিরাপত্তা আওতায় এয়ারপোর্টকে আনা হতো তাহলে আজকের মতো দুর্ঘটনা ঘটতো না।

তাই আমি বলতে চাই, আগামী দিনে যেন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা গুলোতে এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে। একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে কি কি অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব তা আমি বিস্তারিত আলোচনা নিম্নে পেশ করলাম।

একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে (Airport) অগ্নি-নিরাপত্তা (Fire Safety) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ এখানে মানুষ, জ্বালানি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, বিমান, লাগেজ ও বাণিজ্যিক স্থাপনার ঘন উপস্থিতি থাকে। নিচে মূল অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়গুলো ধাপে ধাপে উল্লেখ করা হলো:

১. অগ্নি প্রতিরোধ (Fire Prevention) ব্যবস্থা
বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা: সব বৈদ্যুতিক সংযোগ, প্যানেল, ও কেবলিং আন্তর্জাতিক মানে ইনস্টল ও নিয়মিত পরিদর্শন করা।
জ্বালানি সংরক্ষণ ও পরিবহন নিরাপত্তা: জেট ফুয়েল স্টোরেজ এলাকা আলাদা ও বিস্ফোরণ-প্রতিরোধক (explosion-proof) হতে হবে।
ধূমপান নিষিদ্ধ এলাকা: নির্দিষ্ট “Smoking Zone” ছাড়া অন্যত্র ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এবং রান্নাঘর, হ্যাঙ্গার ও কার্গো এলাকায় ফায়ার সেন্সর স্থাপন।

২. অগ্নি শনাক্তকরণ ও অ্যালার্ম ব্যবস্থা (Detection & Alarm System)
Smoke, Heat ও Flame Detectors: বিমানবন্দর টার্মিনাল, ব্যাগেজ এলাকা, কন্ট্রোল টাওয়ার, পার্কিং ও হ্যাঙ্গারে ইনস্টল করা।
স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম: অগ্নি শনাক্ত হলে সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমে ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় সঙ্গে সঙ্গে সিগন্যাল পৌঁছায় তার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি CCTV ও Building Management System (BMS) এর সাথে ইন্টিগ্রেটেড মনিটরিং সর্বক্ষণিক রক্ষা করতে হবে।

৩. অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা (Fire Suppression System) Sprinkler System)
Foam-based System: টার্মিনাল ভবন, কার্গো ও প্রশাসনিক ভবনে জ্বালানি ট্যাংক ও হ্যাঙ্গার ব্যবহার করতে হবে।
CO₂ বা Clean Agent System: কন্ট্রোল রুম, সার্ভার রুম ও ইলেকট্রনিক এলাকা স্থাপন করতে হবে।
Portable Fire Extinguishers: প্রতিটি নির্দিষ্ট জোনে পর্যাপ্ত সংখ্যায় Portable Fire Extinguishers প্রতিস্থাপন করতে হবে।

৪. অগ্নি প্রতিরোধ ও উদ্ধার (Firefighting & Rescue Operations)
Airport Fire Station অবশ্যই Category নির্ভর ICAO অনুযায়ী) হতে হবে। পাশাপাশি Category 9 বা 10 বিমানবন্দরে একাধিক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ফায়ার ট্রাক থাকা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া দ্রুত প্রতিক্রিয়া দলকে (Rapid Intervention Team) ৩ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হতে হবে। রানওয়ে ও অ্যাপ্রনে বিশেষ ফোম টেন্ডার ও রেসকিউ ইউনিট থাকতেই হবে।

৫. নিরাপদ নির্গমন ও পরিকল্পনা (Evacuation & Planning)
Emergency Exit Signage & Lighting: বিদ্যুৎ না থাকলেও জ্বলতে থাকবে এমন ব্যাটারি ব্যাকাপসহ থাকতে হবে।
Evacuation Plan & Fire Drill: যাত্রী, কর্মচারী ও সিকিউরিটি স্টাফদের নিয়মিত মহড়া চলমান রাখতে হবে।
Public Address System (PA): জরুরি অবস্থায় স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার জন্য Public Address System ব্যবস্থা করতে হবে।

৬. নিয়মনীতি ও প্রশিক্ষণ (Regulation & Training)
ICAO Annex 14, NFPA & Civil Aviation Authority-এর মান অনুসরণ করতে হবে। এবং বছরে অন্তত একবার কর্মীদের প্রশিক্ষণসহ প্রাথমিক অগ্নি নির্বাপণ ও জরুরি সাড়া প্রদানের কৌশল শেখাতে হবে।

৭. উন্নত প্রযুক্তি (Smart Fire Safety Integration)
Fire Detection (Video Analytics): ধোঁয়া বা আগুন শনাক্তে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্টের ব্যবস্থা করতে হবে।
IoT-Enabled Sensors: প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রিয়েল-টাইম মনিটরিং চালু রাখতে হবে।
Digital Twin System: জরুরি অবস্থায় সিমুলেশন ও পূর্বাভাসমূলক বিশ্লেষণ করা জরুরি।

উপরিউক্ত বিষয়গুলো যদি যথাযথভাবে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ অনুসরণ করে আশা করি ভবিষ্যতে এয়ারপোর্টে এই ধরনের দুর্ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

এম এ রশিদ টিপু: প্রাক্তন অ্যাকর্ড, অগ্নিনিরাপত্তা প্রকৌশলী ও সার্টিফাইড ফায়ার প্রটেকশন স্পেশালিস্ট (সিএফপিএস)

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ