Views Bangladesh Logo

গাজায় নিহত বেড়ে ৫৮ হাজার ৭৬৫, ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার দ্বারপ্রান্তে’ ফিলিস্তিনিরা

গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর একের পর এক হামলায় আরও অন্তত ১১৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও ৫১১ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩৮ জনই যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্র খাবারের জন্য এসেছিলেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, গত ২১ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৫৮ হাজার ৭৬৫ জন আর আহত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৮৫ জন।

আইডিএফের এই আগ্রাসন, বিশেষত ত্রাণপ্রার্থী ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যা অব্যাহত থাকায় নিন্দায় মুখর হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, গাজার ২৩ লাখ জনসংখ্যার ১০০ শতাংশই এখন ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ দ্বারপ্রান্তে, যেখানে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে।


একজন চিকিৎসক জানান, গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে ৩৫ দিনের শিশুসহ আরও দুই ফিলিস্তিনি অপুষ্টিতে মারা গেছেন।


স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, ইসরায়েলি বিমান ও ড্রোন হামলা এবং স্থল অভিযানে শুক্রবার (১৮ জুলাই) রাতভর ২৬ জন ও শনিবার (১৯ জুলাই) ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও ৯০ জন নিহত হন। তাদের মূল লক্ষ্যবস্তুই এখন জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্র এবং বাস্তুচ্যুত আশ্রিত ফিলিস্তিনিদের তাঁবুগুলো।

দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে এ ধরনের একটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিবর্ষণে ৩৮ জন নিহত ও অন্তত ৮০ জন আহত হন। নিহতদের মরদেহ ও আহতদের নেয়া হয়েছে নাসের হাসপাতালে।

হাসপাতালটি জানায়, ত্রাণকেন্দ্র ছাড়াও উত্তর গাজার জাবালিয়ার আল-নাজলাতেও ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালালে দুজন নিহত হন। গাজা শহরের দারাজ পাড়া ও খান ইউনিস শহরের পূর্ব ও পশ্চিমে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নেয়া তাঁবুগুলোতেও বোমা হামলা চালায় বিমান বাহিনী। শুধু খান ইউনিসের পশ্চিমের একটি তাঁবুতেই কমপক্ষে ছয়জন নিহত হন। অন্যদিকে পূর্বের বানি সুহেলায় ইসরায়েলি হামলার স্থান থেকে চারজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানায় হাসপাতালটি।

আল-আহলি হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, গাজা শহরের দক্ষিণে জেইতুন পাড়ায় দুটি ইসরায়েলি বিমান হামলায় তিনজন নিহত হন। ব্যাপটিস্ট হাসপাতাল জানায়, শহরের তুফাহ পাড়ায় একটি ইসরায়েলি ড্রোন অন্য একজনকে হত্যা করেছে।

চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালগুলোতে নতুন করে ভর্তি হওয়া ৫১১ জন আহতের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। হতাহতদের আধিক্যে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। নাসের হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং জ্বালানিও ফুরিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে আল জাজিরা বলছে, দুর্ভিক্ষের মুখে পড়া ২১ লাখ গাজাবাসীর জন্য খাদ্য বিতরণও এখন খুবই সীমিত। নিজেদের আটা ও চাল নেই এবং যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা খুবই ব্যয়বহুল এবং কেউ তা বহন করতে পারেন না। সামান্য যা কিছু খাবার পাওয়া যায়, সেগুলো আসে জিএইচএফের কেন্দ্রগুলো এবং তাও সামান্য। তাই মৃত্যুঝুঁকির মুখেও ওই কেন্দ্রগুলোতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ।

উত্তপ্ত সূর্যের নিচে দীর্ঘপথ হেঁটে এই কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছান ফিলিস্তিনিরা। তারা আল জাজিরাকে বলেন, তাদের হারানোর কিছু নেই। হয় তারা অনাহারে মারা, নয়তো ইসরায়েলি হামলার আগুনে মারা যাবেন।


জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে খাবার আনতে চেষ্টা করা মোহাম্মদ আল-খালিদি বলেন, ‘ট্যাঙ্কগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। আমরা ভেবেছিলাম, তারা আমাদের সংগঠিত করতে এসেছে, যেন আমরা সাহায্য পেতে পারি’ ।

‘হঠাৎ আমরা একপাশ থেকে জিপগুলোকে আসতে দেখলাম। অন্যপাশ থেকে ট্যাঙ্কগুলো এসে আমাদের দিকে গুলি করতে শুরু করল। আমাদের ভয় দেখানো বা সংগঠিত করতে গুলি চালানো হয়নি। বরং আমাদের হত্যা করতেই গুলি চালানো হয়েছিল’।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ আল-বারবারে বলেন, ‘এটি সাহায্যের জন্য কোনো স্থান নয়, এটি একটি ফাঁদ, একটি মৃত্যুফাঁদ, যে কেউ মারা যেতে পারে’।

দেইর এল-বালাহ থেকে আল জাজিরার হিং খোদারি বলেন, ‘যদি ইসরায়েল গাজায় আরও খাবার প্রবেশ করতে না দেয়, তাহলে ফিলিস্তিনিদের কেবল কিছু খেতে জীবনের ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই’।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাবে, ২৭ মে থেকে গাজায় খাদ্য বিতরণের অপেক্ষায় থাকা ৯১৩ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের বেশিরভাগই জিএইচএফ সাইটের আশেপাশে নিহত হয়েছেন। 


ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে ‘গণহত্যা’ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি অনাহার ও অপুষ্টিতে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। এই আন্তর্জাতিক নীরবতা অব্যাহত থাকলে ‘অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য ও মানবিক বিপর্যয়ের’ বিষয়ে সতর্ক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থাটি।

অপুষ্টির সংকট আরও তীব্র হওয়ায় গাজার হাসপাতালগুলোতে চাপ তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও। তাদের সর্বশেষ বিবৃতিতে বলা হয়, গাজায় খাদ্য সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।অভূতপূর্ব সংখ্যক মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং তাদের চরম ক্লান্তি ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।


অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মুসলিম গোষ্ঠী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘মার্কিন করদাতাদের সরবরাহকৃত কোটি কোটি অস্ত্র এবং সাহায্যের সহায়তায় জোরপূর্বক’ গাজায় ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখার অভিযোগ করেছে।


২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর জবাবে ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে গাজার বিভিন্ন এলাকায়।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও, ১৮ মার্চ থেকে পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন সাত হাজার ৯৩৮ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৪৪ জন।

এদিকে, ধারণা করা হচ্ছে, হামাসের হাতে আটক থাকা ২৫১ জন জিম্মির মধ্যে এখনো অন্তত ৩৫ জন জীবিত আছেন। আইডিএফ জানিয়েছে, তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

গাজায় চলমান এ সহিংসতা থামাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র ইসরায়েলকে বারবার আহ্বান জানালেও তেল আবিবের অবস্থান অপরিবর্তিত। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, হামাসকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করা এবং সব জিম্মিকে মুক্ত করা পর্যন্ত সামরিক অভিযান চলবে।

এ অভিযানেরই অংশ হিসেবে তাদের বিমান বাহিনী শুক্র ও শনিবার অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাজুড়ে ৯০টি হামলা চালিয়েছে, যার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার বলে জানিয়েছে আইডিএফ। তাদের দাবি, কেবলমাত্র সামরিক কম্পাউন্ড ও ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোতেই আঘাত করেছে তারা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ