Views Bangladesh Logo

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত বেড়ে ৫৭৫২৩ জন

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বশেষ অভিযানে এক দিনেই নিহত হয়েছেন অন্তত ১০৫ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন অন্তত ৩৫৬ জন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণকেন্দ্রে খাদ্য ও ত্রাণ আনতে যাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষও।

তবে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুসারে, প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। বহু মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন, যাদের এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলা করা অধিকাংশ স্থানে মানবাধিকার কর্মীরা পৌঁছাতেই পারছেন না।

এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত প্রায় ২১ মাসে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৫২৩ জনে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৩৬ হাজার ৬১৭ জন। হতাহতদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি বাহিনী এই সময়ে গাজার ১৫ হাজারেরও বেশি শিশুকে হত্যা করেছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানের লাগাতার বোমাবর্ষণে নিহতদের মধ্যে গাজা সিটিতেই প্রাণ গেছে ৩৯ জনের। এর মধ্যে শেখ রাদওয়ান এবং আল-নাসর পাড়ায় বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে আশ্রয় দেয়া দুটি বাড়িতে ২৫ জন নিহত হয়েছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গভীর রাতে পরিবারগুলো যখন ঘুমে ছিল, তখন বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে রয়েছে বেশ কয়েকজন।

আল-আওদা হাসপাতালের বিবৃতি অনুসারে, মধ্য গাজায় একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে চার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এতে আরও ২৫ জন আহত হয়েছেন।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গাজা সিটি এবং মধ্য গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে দুটি বেসামরিক সমাবেশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের হামলায় ছয়জন নিহত এবং আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে আনাদোলু এজেন্সি ও ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, উত্তর গাজা সিটির আল-সাফতাউই পাড়ায় একটি বেসামরিক গাড়িতেও একটি ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালিয়ে তিন ভাইকে হত্যা করেছে।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আরও জানান, শেখ রাদওয়ানে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয়কেন্দ্রে আরেকটি ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় তিনজন নিহত এবং আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। শেখ রাদওয়ানে ইসরায়েলি হামলার পর বেঁচে ফেরা লোকজন ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সেখানকার দৃশ্য ছিল ‘প্রলয়ের মতো’। নিহতদের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হচ্ছিল, আর ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছিল।

পশ্চিম গাজা সিটির শাতি শরণার্থী শিবিরের একটি স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শিশুসহ সাতজন নিহত হয়েছেন বলেও জানান চিকিৎসকরা। গাজা সিটির অন্যত্র আল-তুফাহ পাড়ার একটি আবাসিক বাড়িতে ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে দুজন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিপজ্জনক নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসা দল তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।

উত্তর গাজা সিটিতে একটি গাড়িতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন আরও তিনজন ফিলিস্তিনি। আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতাল সূত্র জানায়, শনিবার রাতে গাজা সিটির আল-দারাজ পাড়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় একই পরিবারের তিনজন নিহত এবং আরো কয়েকজন আহত হয়েছেন।  গাজা শহরের এক হামলা থেকে বেঁচে ফেরা মাহমুদ আল-শেখ সালামা জানান, স্থানীয় সময় শনিবার রাত দুইটার দিকে যখন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন, তখন ওই হামলা হয়।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনি, তারপর আরেকটা বিস্ফোরণ। আমরা দৌঁড়ে যাই… এবং দেখি অনেক মানুষ ধ্বংসস্তুপে আটকে আছে—চারটি পরিবার, বহু বাসিন্দা। আমরা বেঁচে থাকা লোকদের খুঁজতে থাকি এবং প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা করে ধ্বংসস্তুপ ভেঙে দুজনকে জীবিত বের করতে সক্ষম হই। বাকি সবাই শহীদ হয়েছেন এবং এখনো আটকে আছেন’।

আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা শহর থেকে বলেন, ইসরায়েলের এই নতুন হামলার তীব্রতা ও ব্যাপকতা এতোটাই বেশি যে, ‘যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহগুলোর ভয়ঙ্কর ও নির্মম চিত্র স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে’। তিনি জানান, ‘দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাতটি বিমান হামলা গণনা করেছি’।

তিনি আরও বলেন, ‘উত্তর দেইর আল-বালাহ এলাকার একটি স্থানীয় কমিউনিটি কিচেনেও হামলা হয়েছে। এতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে মূল রান্নার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও ছিলেন।’ নাসের ও কুয়েত ফিল্ড হাসপাতালের মেডিকেল টিম জানায়, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের আল-মাওয়াসি এলাকায় বাস্তুচ্যুত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য তৈরি অস্থায়ী তাঁবুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় শিশু ও একজন গর্ভবতী নারীসহ কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খান ইউনিসের আল-আলবানি মসজিদের কাছে তাঁবুতে আরেকটি ড্রোন হামলার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে তিন শিশুসহ আরও চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী রাতভর পূর্ব গাজা শহর এবং ছিটমহলের উত্তর অংশে আবাসিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোতেও বোমাবর্ষণ করেছে। সারা রাত ধরে ক্রমাগত বিস্ফোরণের খবর দিয়েছেন বাসিন্দারা।

মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ উপকূলে কাজ করার সময় ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে একজন ফিলিস্তিনি জেলে আহত হয়েছেন। মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে একটি তাঁবুতে অন্য একটি ড্রোন হামলায় একই পরিবারের আটজন নিহত হন। আরেকটি হামলায় একই শরণার্থী শিবিরে তিনজন নিহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান এখনও চলছে।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় অন্তত ১৩০টি জায়গায় বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি উদ্বাস্তু শিবির আছে বলেও তারা জানিয়েছে। মূলত সমুদ্রের ধার ঘেসে একাধিক জায়গায় আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে ইসরায়েলের সেনা দাবি করেছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোববার এক পরিসংখ্যানে জানায়, উপত্যকায় ইসরাইলি ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ত্রাণ উদ্যোগ গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) কেন্দ্রগুলো থেকে খাবার সংগ্রহ করার সময় কমপক্ষে ৭৪৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত চার হাজার ৯১৬ জন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকস্মিক হামলার পর থেকেই গাজায় অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ)। হামলায় ইসরায়েলে অন্তত এক হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।

হামলার জবাবে শুরু হওয়া অভিযানে একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরায়েল। তবে ওই বিরতি ভেঙে ১৮ মার্চ থেকে আবারও গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই আক্রমণে গত আড়াই মাসে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৬ হাজার ৯৬৪ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন অন্তত ২৪ হাজার ৫৭৬ জন।

হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ২৫১ জনের মধ্যে এখনো অন্তত ৩৫ জন জীবিত রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সামরিক অভিযান চালিয়েই তারা জিম্মিদের উদ্ধার করতে চায়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ