ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ৬১১৫৮ ফিলিস্তিনি, ‘দুর্ভিক্ষে’ ১৯৩ জন
গত ২৪ ঘণ্টায় গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন আরও ১৩৫ জন ফিলিস্তিনি, যাদের ৮৭ জনই ত্রাণপ্রার্থী। আহত আরও ৭৭১ জনকে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে জোরপূর্বক অনাহার ও অপুষ্টিতে মারা গেছেন একজন শিশুসহ আরও পাঁচজন।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, এ নিয়ে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রায় ২২ মাসে নিহত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ১৫৮ জনে এবং আরও অন্তত এক লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ জন আহত হয়েছেন। মিউল ইস্ট আই জানায়, নিহতদের মধ্যে ১৮ হাজার ৪৩০ জনই শিশু। অন্যদিকে ‘দুর্ভিক্ষে’ মারা গেছেন ১৯৩ জন, যাদের ৯৬ জনই শিশু।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, প্রয়োজনীয় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে যুদ্ধে ‘সাময়িক বিরতির’ ঘোষণা দিয়েও গাজাজুড়ে বিমান ও ড্রোন হামলা এবং স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) দিনভর এসব হামলায় নিহত ১৩৫ জন ফিলিস্তিনির ৮৭ জন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে খাবারের জন্য এসেছিলেন। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগের ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসস্তূপ থেকে তিনটি মৃতদেহও উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে বুধবারও (৬ আগস্ট) ভোর থেকে হামলা চালাচ্ছে ইসিরায়েলি সেনারা। দুপুর পর্যন্ত আরও ২৩ জনকে হত্যা করেছে তারা, যাদের ছয়জন ত্রাণপ্রার্থী মারা যান উত্তর গাজার জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে গিয়ে।চিকিৎসাকর্মীরা জানান, সেখানে আহতদের আল-শিফা হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলির চিহ্ন রয়েছে, বিশেষত মাথা, গলা ও বুক। এই ক্ষতগুলো চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত জটিল।
আল-আওদা হাসপাতালের সূত্র জানিয়েছে, নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরের উত্তরে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি হামলায় একজন নারী ও দুই শিশুসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকা থেকে আলজাজিরা জানায়, ‘২৭ মে জিএইচএফের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানকার ত্রাণকেন্দ্রেও একই ঘটনা ঘটছে। মানুষ খাবারের আশায় লাইনে দাঁড়াচ্ছে, আর তাদের ওপর গুলি চালানো হচ্ছে’।
জিএইচএফের সক্ষমতা ও এর কার্যক্রমের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোও। সংস্থাগুলোর অভিযোগ, যথাযথ সহায়তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি এই এলাকাগুলোতে নিরাপত্তার চরম অভাব রয়েছে। তাদের হিসেব অনুসারে, এখন পর্যন্ত গাজায় সহায়তার আশায় বের হয়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত এক হাজার ৬৫৫ জন ফিলিস্তিনি, আহত হয়েছেন আরও ১১ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে মে মাসে ২০ জন, জুনে ৫৮১, জুলাইয়ে ৭২৯ এবং আগস্টের প্রথম পাঁচদিনেই মারা গেছেন ২৩৮ জন।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসও বিবৃতিতে আবারও সতর্ক করে জানিয়েছে, ‘মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে’। তাদের দাবি, সহায়তা আসার পর তা পরিকল্পিতভাবে লুট হচ্ছে, যা ইসরায়েলি বাহিনীর সৃষ্টি করা নিরাপত্তা শূন্যতার সুযোগে সংঘটিত নৈরাজ্যেরই অংশ। ইসরায়েল গাজায় প্রভাব ফেলতে থাকা মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং ‘বিশৃঙ্খলার প্রকৌশল’ আরও জোরদার করছে।
মধ্য গাজায় অনিরাপদ রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় একটি ট্রাক উল্টে যাওয়ার পর খাদ্য সহায়তা প্রার্থী ২০ জন নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে অফিসটি।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, খাদ্য বহনকারী ট্রাকটি তাদের ওপর উল্টে গেছে, যখন দখলদার বাহিনী ট্রাকটিকে অনিরাপদ রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করতে বাধ্য করেছিল। ওই রাস্তাগুলোতে আগেই বোমা হামলা করা হয়েছিল এবং যাতায়াতের উপযুক্ত ছিল না।এটি ‘বিশৃঙ্খলা ও অনাহারের প্রকৌশলে’র অংশ হিসাবে বেসামরিক নাগরিকদের বিপদ ও মৃত্যুর দিকে জোর করার দখলদার বাহিনীর ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা প্রকাশ চালায়’।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা দখলদার বাহিনীর অনুশীলন করা এই ইচ্ছাকৃত অপরাধমূলক নীতির তীব্র নিন্দা জানাই, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে গণহত্যার পূর্ণাঙ্গ অপরাধ’।
এতে আরও বলা হয়েছে, গাজার পরিস্থিতি ‘সব রেডজোন’ অতিক্রম করেছে।
অন্যদিকে মানবিক সাহায্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সতর্ক করে জানিয়েছেন, গাজায় বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
৭৫ বছর বয়সী সালিম আসফুর আল জাজিরাকে বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে শুধু রুটি আর পানি খেয়ে বেঁচে আছি। একসময় ৮০ কেজি ছিলাম, এখন ওজন ৪০ কেজিতে নেমে এসেছে। ছেলে আমাকে বাথরুমে নিয়ে যায়। রাফাহ থেকে খাবার আনতে হবে, ২০ কিলোমিটার হেঁটে কীভাবে যাব?’
ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ ও শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানায়, মঙ্গলবার গাজায় মাত্র ৯৫টি সহায়তাবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে, যেখানে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা পূরণে দিনে অন্তত ৬০০ ট্রাক প্রয়োজন। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৮৫টি ট্রাক প্রবেশ করছে, যা চরমভাবে অপর্যাপ্ত।
খান ইউনিসের কুয়েতি হাসপাতালের প্রধান ডা. সুহাইব আল-হামসও ফিলিস্তিনিদের কাছে সাহায্য গ্রহণে ‘মৃত্যুর ফাঁদ’ জিএইচএফের সাহায্যকেন্দ্রগুলোর ব্যবহার এড়াতে অনুরোধ করেছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। গাজায় এখনও প্রায় ৫০ জন বন্দী রয়েছে। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন জীবিত বলে মনে করা হচ্ছে। তাদেরকে উদ্ধারের কথা বলেই ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে গাজাজুড়ে।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী দেশের চাপে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও ১৮ মার্চ থেকে ফের সামরিক অভিযান চালাচ্ছে আইডিএফ। দ্বিতীয় দফার এই অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন নয় হাজার ৫৭৫ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৩৮ হাজার ৭৫৭ জন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে