বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু এবং একটি দালিলিক এপিটাফ
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার বাংলাদেশের সৎ সাংবাদিকদের জন্য একটি বেদনার বার্তা রেখে গেছেন, যেটাকে বলা যেতে পারে তার নিজের লিখে যাওয়া এপিটাফ। যে এফিটাফ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে পেশাদার সাংবাদিকতার দৈন্যদশার নিদারুণ দলিল।
নিখোঁজ হওয়ার আগে বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ভোরে তিনি ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে একটি লেখা বিডিনিউজের মেইলে পাঠিয়ে সেখানে নোট হিসেবে লিখেছেন: এটা জীবনের শেষ লেখা হিসেবে ছাপতে পারেন। শোনা যায়, তিনি তার এক বন্ধুর ফোনে একটা এসএমএস করে গেছেন। যেখানে শুধু একটি শব্দ লেখা: ‘বিদায়।’ বৃহস্পতিবার সকালে তিনি বাসা থেকে বের হন মোবাইল ফোন সঙ্গে না নিয়েই। ফোনটি সঙ্গে নেননি যাতে কেউ ট্র্যাক করতে না পারে। পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যার আগে খবর এলো যে, বিভুরঞ্জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে মুন্সীগঞ্জের কোনো একটি জায়গা থেকে। মেঘনা নদীতে ভাসছিল মরদেহ।
অতএব, তার মৃত্যুকে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করছি। বাসা থেকে বেরিয়ে হয়তো বাসে, সিএনজিতে কিংবা অন্য কোনো বাহনে অথবা ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে কোনো সেতুর ওপর দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছেন। পৃথিবীকে বিদায় বলেছেন। বিদায় বলেছেন বন্ধু, পরিজন, সুহৃদ, সহকর্মী এবং শত্রুদেরও। তারপর ভাটার টান তাকে হয়তো টেনে নিয়ে গেছে নদীর দক্ষিণ দিকে। এটা নিতান্তই কল্পনা। বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুটা আসলে কীভাবে হয়েছে তা হয়তো কোনোদিন জানা যাবে অথবা যাবে না। তবে তিনি এখন নির্ভার, নিশ্চিন্ত।
যে খোলা চিঠিকে তিনি জীবনের শেষ লেখা বলে উল্লেখ করলেন- সেটিকে একজন ব্যক্তি বিভুর অভিমানের খেয়াল; মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেও সার্টিফিকেট না নেয়া একজন বীরের ক্ষোভ কিংবা একজন সৎ সাংবাদিকের অসহায়ত্বের বিবরণ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এই খোলা চিঠি বা এই সুইসাইড নোট মূলত বাংলাদেশের সব সৎ সাংবাদিকের পক্ষ থেকে একটি সম্মিলিত ঘোষণাপত্র। পেশাদারিত্ববিবর্জিত একটি পেশার মানুষের পক্ষ থেকে পেশ করা একটি যৌথ ঘোষণা।
বিভুরঞ্জন বলে গেলেন, তোমরা যারা সাংবাদিকতার মতো একটি অনিশ্চিত এবং অপেশাদার কাজকে ‘মহান পেশা’ বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগো এবং যারা নিজেদের ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ মনে করে নিরর্থক শ্লাঘা বোধ করো- তাদের পরিণতি আসলে বিভুরঞ্জন সরকার- যদি তুমি সৎ থাকো এবং একইসঙ্গে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সাহসিকতার সঙ্গে বলা ও লেখার চেষ্টা কর। সে কারণে এই খোলা চিঠিতে বিভুরঞ্জন লিখলেন: ‘সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।’ সত্য লিখে বাঁচা যে সহজ নয়- এই সত্য কথাটি এখন কজন বলতে পারেন? এখন সত্য বললেই বিগত সরকারের দোসর। আবার বিগত সরকারের সময় সত্য বললে বলা হতো বিএনপি-জামায়াতের দোসর। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকদের এই ট্যাগ খাওয়া বন্ধ হয়নি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী ‘নতুন বাংলাদেশে’ এই ট্যাগিংয়ের রাজনীতি এখন আরও ভয়াবহ।
তবে যাদের ট্যাগ দেয়া হয় বা হয়েছে, তাদের সবাই ধোয়া তুলসিপাতা নন। প্রতিটি সরকারের আমলেই সাংবাদিকদের একটি বিরাট অংশই সরকার ও সরকারি দলের কাছ থেকে নানাবিধ সুবিধা নিয়েছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে অনেক সাংবাদিক সরকারি নানা প্রকল্পে যুক্ত থেকে এবং নানারকম তদ্বির বাণিজ্য করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, এরকম অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি অসংখ্য সাংবাদিক শতভাগ সৎ ও পেশাদারি বজায় রেখে সাংবাদিকতা করেছেন এবং এখনো করছেন।
বাস্তবতা হলো, সুবিধা নেয়া সাংবাদিকের সংখ্যা কোনো আমলেই খুব বেশি হয় না। হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ সবার হয় না। সবাই যান না। অনেকে যেতে পারেন না; কিন্তু রাষ্ট্রীয় বা দলীয় সুযোগ-সুবিধা না নিয়েও অসংখ্য সাংবাদিক ট্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। হচ্ছেন। বিভুরঞ্জন তাদেরই একজন। খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছেন: শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেয়া হয়; কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে।
বিভুরঞ্জনের এই মৃত্যুকে আমরা যদি আত্মহনন হিসেবে ধরে নিই বা মেনে নিই তাহলে এটি একটি কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত হত্যাকাণ্ড। কেননা, বিভুরঞ্জন সাংবাদিকতা পেশার যেসব সংকটের কথা লিখেছেন, সেখানে রাষ্ট্রের দায় আছে। একটি দেশের গণমাধ্যম কেমন চলেছে, সেখানে পেশাদারি গড়ে উঠলো কি না, কর্মীরা সময়মতো ন্যায় মজুরি পাচ্ছেন কি না; সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিত করছে কি না- এগুলো কে দেখবে? সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে কি প্রকাশ ও প্রচার করলো তা নিয়েই তটস্থ থাকবে, নাকি সাংবাদিকরাও যে একটি বিরাট কমিউনিটি, সেই কমিউনিটির মানুষরা কেমন আছে, সেই খোঁজটুকুও রাখবে?
বিভুরঞ্জনের মতো লোকদের কেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে সহায়তার অনুরাধ করতে হবে? তিনি লিখেছেন: ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করে কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন। আমি দুইবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালিটি পাইনি। একেই বলে কপাল! তবে হ্যাঁ, একবার শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ওই সফরের জন্য কিছু হাত খরচের টাকা আমি পেয়েছিলাম; কিন্তু সেটা তো ওই কোট-প্যান্ট-জুতা কিনতেই শেষ হয়, আরও দেনা হয়েছে। ওই সুবাদে আমার কোট-টাই-জুতা কেনা! সারাজীবন তো স্যান্ডেল পরেই কাটল।’
তিক্ত হলেও এটা নির্মম সত্য যে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা হচ্ছে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরার একটা ইমোশনাল প্রফেশন। লোকরা ভালোবেসে এই পেশায় আসে। একটা রোমাঞ্চ কাজ করে। তারপর একটা অবিচ্ছদ্য বন্ধনে আটকে যায়। যে বন্ধন অধিকাংশের পক্ষেই আর ছিন্ন করা সম্ভব হয় না; কিন্তু তার বয়স যত বাড়তে থাকে, তার চাকরির ঝুঁকি তত বাড়ে।
মালিকরা নিজেদের নানাবিধ ব্যবসা ও ধান্দাবাজির জন্য একেকটা পত্রিকা ও টেলিভিশন চালু করবেন; কিন্তু তার কর্মীদের জন্য কোনো পেনশনের ব্যবস্থা রাখবেন না; প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করবেন না। দুই হাজার টাকা ইনক্রিমেন্ট দেয়ার আগে কর্মীদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন। অথচ ওই সাংবাদিকদের কারণেই তার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে। টিকে থাকে।
ধরা যাক কোনো মালিকের সংবাদপত্র বা টেলিভিশন ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই- যেগুলোর সুরক্ষায় তিনি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করবেন; কিন্তু তারপরও তার ওই পত্রিকা বা টেলিভিশনের কোনো বিজনেস মডেল নেই। এটা আল্লাহর ওয়াস্তে বা এতিমখানার মতো করে চলবে। তার কর্মীর না থাকবে নিয়োগপত্র, না থাকবে নিয়মিত ও সম্মানজনক বেতন, না থাকবে তার অন্যান্য আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা। অথচ ওই সাংবাদিকদের কাছ থেকেই দেশের মানুষ সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা প্রত্যাশা করে বসে থাকে।
যে লোকের নিজের চাকরির খবর নেই; নিজের বেতন ঠিক নেই- সে বকেয়া বেতনের দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের খবর সরাসরি সম্প্রচার করে।
সাংবাদিকতার মতো অনিরাপদ ও অনিশ্চিত পেশা দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন। একজন দিনমজুরের চেয়েও এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যিনি দিনমজুর তিনি শ্রম দিলে পয়সা পান; কিন্তু অসংখ্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মাসের পর মাস বেতন পান না। অথচ কাজ করছেন। পাওনা টাকা কবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে অনেকেই বিপথে পা বাড়ান। ধান্দাবাজির পথ বেছে নেন। সুযোগ পেলে সরকারি সুবিধা নেন; কিন্তু সবাই এটা করেন না। সবাই এটা চাইলেও পাবেন না। এর জন্য বিশেষ যোগ্যতা লাগে। যাদের এই যোগ্যতা নেই, তাদের পরিণতি বিভুরঞ্জন সরকার।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এমনই এক পেশা যেখানে বয়স ও অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চাকরি ঝুঁকিতে পড়ে, চাকরির বাজার সংকুচিত হয়। মালিকপক্ষও তাকে বোঝা মনে করতে থাকে। বরং একজন সিনিয়র চলে গেলেই খুশি হন। কারণ ওই সিনিয়রের বেতনে অন্তত দুজন নতুন লোক নেয়া যাবে; কিন্তু একজন বিভুরঞ্জন হয়ে উঠতে যে সময়, যে মেধা, যে শ্রম দিতে হয়- সেই মেধা, জ্ঞান, শ্রম ও দক্ষতার মূল্য মালিকের কাছে নেই। ফলে দিন শেষে একটি সুইসাইড নোট লিখে তাকে নদীতে ঝাঁপ দিতে হয় অথবা অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হয়।
যে মানুষটির লেখার কারণে একসময় সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; যিনি দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক রূপালী, সাপ্তাহিক চলতিপত্র, মৃদুভাষণ, দৈনিক মাতৃভূমির মতো পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন; দেশের প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইনে নিয়মিত যার কলাম প্রকাশিত হতো- সেই মানুষটিকে যদি জীবনের শেষবেলায় এসে ওষুধের টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়- তাহলে ওই সততা, ওই সাহস, ওই দেশপ্রেমের কী মূল্য আছে? কেন একজন সৎ সাংবাদিকের ‘দুঃখই জীবনের শেষ সঙ্গী’ হবে?
যে সততা, সাহস ও দেশপ্রেম একজন সৎ সাংবাদিকের ভাত-কাপড় আর ওষুধের ব্যবস্থা করতে পারে না- সেই পেশায় কেন শিক্ষিত তরুণরা আসবে বা আসতে চাইবে? আর যদি শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণরা সত্যিই এই পেশায় না আসে তাহলে সেই শূন্যতা পূরণ করবে আধাশিক্ষিত, দলবাজ, টাউট ও বদমাশ লোকরা। দেশের গণমাধ্যম যদি একসময় সত্যিই অসৎ, আধাশিক্ষিত ও দলবাজদের দখলে চলে যায় তাহলে সাংবাদিকতা বলে কিছু থাকবে না। সেখানে থাকবে শুধু ক্ষমতাবানদের প্রশংসা আর থাকবে গুজব-মিথ্যা-প্রোপাগান্ডা- যা দেশকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে