Views Bangladesh Logo

ডিসেম্বর ১৩

স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলাদেশের নির্ণায়ক দিন

 VB  Desk

ভিবি ডেস্ক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল এক উত্তেজনাপূর্ণ, সংকটঘেরা এবং একই সঙ্গে মুক্তির প্রত্যাশায় ভরপুর দিন। সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চারদিক থেকে ক্রমশ অগ্রযাত্রায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। এই দিনটিকে ইতিহাসে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকে ত্বরান্বিত করেছিল।

১৩ ডিসেম্বর সকালে ঢাকা কার্যত চারদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। টঙ্গী–গাজীপুর অঞ্চল দখলে নিয়ে শহরের প্রবেশমুখ নিয়ন্ত্রণ করে নেয় মিত্রবাহিনী। নরসিংদী–রূপগঞ্জ হয়ে দ্রুত অগ্রসর হয়ে ঢাকার পূর্বদিকের প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলা হয়। সাভার–মানিকগঞ্জ হয়ে ভারতীয় সেনার ২ ও ৯ নম্বর ডিভিশন ঢাকার দিকে এগিয়ে আসে। নারায়ণগঞ্জ–মুন্সীগঞ্জ এলাকা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে।

এদিন ঢাকাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রসর হওয়ায় ঢাকাও হয়ে পড়ে ঘেরাওকৃত দ্বীপ। ফলে, পাকিস্তানি সেনাদের ভেঙে পড়া মনোবল। পাশাপাশি গোলাবারুদ ও রসদের ঘাটতিও তখন চরমে। আকাশ ও স্থলপথে মিত্রবাহিনীর দখলে চলে যায়। পাকিস্তানি কমান্ড কাঠামোর মধ্যেও তৈরি হয় চরম বিশৃঙ্খলা।

এদিন পাকিস্তানি জেনারেলরা বুঝতে পারেন, ঢাকা রক্ষা করাও আর সম্ভব নয়। রাতের অন্ধকারে আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে।

কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র তখনও চলছিল। ১২ ডিসেম্বর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ও দোসর আলবদররা পরিকল্পনা করতে থাকে এ দেশকে ছেড়ে গেলেও করে যাবে মেধাশূন্য। সে ধারাবাহিকতয় বুদ্ধিজীবী নিধনের অভিযান শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর এই তৎপরতা আরও তীব্র হয়।তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক ও জ্ঞানী মানুষদের চিহ্নিত করে ধরে নিয়ে যায় বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নিখোঁজ হওয়া মানুষের খবর উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। ঠিক পরদিন ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় ভয়াবহ বুদ্ধিজীবী গণহত্যা।

ঢাকার আকাশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর টহল, স্থলে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা—সব মিলিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী রীতিমতো কোণঠাসা।
শহরের মানুষের মধ্যে ভয়ের উদ্বেগ ও আশা সঞ্চার একই সাথে মিলিত হয়। কোথাও গোলাগুলি, কোথাও পাকিস্তানি সৈন্যদের পালানোর চেষ্টা, আবার কোথাও মুক্তিবাহিনীর আগমন নিয়ে উল্লাস, ঢাকা যেন অপেক্ষা করছিল মহামুহূর্তের।

এদিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বাংলাদেশের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপেও যুদ্ধ থামাতে পাকিস্তানের ওপর কোনো কার্যকর সমর্থন মিলছিল না। ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া যুদ্ধবিরতি সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান বজায় রাখে। বিশ্ববুদ্ধিজীবী সমাজ এবং মিডিয়ায় পরিষ্কার হয়ে যায়—পাকিস্তানের পরাজয় অনিবার্য।

১৩ ডিসেম্বর ছিল যেন স্বাধীনতার দরজায় শেষ কড়া। যুদ্ধের বাস্তবতা স্বচ্ছ কাঁচের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে। মাত্র তিন দিন পর, ১৬ ডিসেম্বর, রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ