Views Bangladesh Logo

আত্মঘাতী অন্তর্ঘাতের মূল্য অনেক বড় হতে পারে

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

সোমবার সকালে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলাম। দূর থেকে করা ভিডিওতে দেখা যায় আগুনের শিখা লম্বা গাছপালা ছাড়িয়ে আকাশে উঠেছে। রাতের আকাশে লেলিহান আগুনের শিখা। হঠাৎ মনে হলো ভিডিওটা ইউক্রেন বা গাজার নয়তো? ভুল ভাঙলো একটু পর। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানলাম, এটা ভিনদেশের ধ্বংসযজ্ঞ নয়। ঢাকার উপকণ্ঠে সাভারে অবস্থিত সিটি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দিয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বীভৎসতা চিত্র আরও পরিষ্কার হতে থাকে।

প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, একদল দাঙ্গাবাজ সিটি ইউনিভার্সিটির যানবাহন, অফিস, শ্রেণি কক্ষ, ইনডোর খেলার জায়গাসহ বিভিন্ন জায়গায় তাণ্ডব চালিয়ে রীতিমতো তামা তামা করে ফেলেছে। আগুন দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির যানবাহন ও মূল ফটকে। মধ্যযুগে ভারতে বিভিন্ন রাজ্য দখলের পর যেভাবে সম্পদ লুটপাট ও সিংহদ্বারে অগ্নিসংযোগ করা হয় অনেকটা ঠিক সেই চিত্রনাট্য।

ভয়াবহ এই ঘটনার পেছনে দায় কার, কে উসকানি দিয়েছেন- সেসব বিষয় হয়তো পরে যথাযথ অনুসন্ধানের পর জানা যাবে; কিন্তু এই কাজ যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। আর এই বিষয়টিই ভীতিকর। একবার চিন্তা করে দেখুনতো আমরা কী এক প্রজন্ম তৈরি করছি? যারা অতি তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই পর্যায়ের ধ্বংসাত্মক হামলা চালাতে পারে? জ্বালিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া, গুড়িয়ে দেওয়ায় নেশায় পেয়ে বসা এই তরুণদের কে থামাবে? কে, কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? কীভাবে সভ্যতা শেখাবে? কীভাবে সহনশীলতা শেখাবে, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধশীল হিসেবে গড়ে তুলবে?

পাঁচ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের শিক্ষাঙ্গনে এক ভীতিকর চর্চা চলছে। এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আরেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপর হামলে পড়ছেন অতি তুচ্ছ কারণে, রীতিমতো পশুর জিঘাংসায়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের মারামারি রীতিমতো রুটিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এ ওকে মারছে, কাল অন্যরা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখার কেউ নেই। গত বছরের নভেম্বর মাসের কথা মনে আছে। সেই প্রায় একই ধরনের তুচ্ছ কারণে পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে দানবীয় হামলা চালিয়েছিল ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। আক্রান্ত হয়েছিল ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।

এখানেই শেষ নয়। এরপর মোটামুটি ঘোষণা দিয়ে পরের দিন ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ। প্রাকশ্য দিবালোকে, চোখের সামনে চলে এই তাণ্ডব ও লুটতরাজ। বলাই বাহুল্য এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল নীরব দর্শক, অবিশ্বাস্য রকমের নিষ্ক্রিয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে গত বছর পাঁচ আগস্টের পালাবদলের পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে; কিন্তু প্রায় এক বছর পরও ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে সিটি ইউনিভার্সিটির ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটতরাজ পুলিশ বাহিনী প্রায় চেয়ে চেয়ে দেখল, তা বিস্ময়কর।

শিক্ষাঙ্গন ভাঙচুর, লুটপাট ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার এই মহাযজ্ঞে কোন প্রাণহানি হয়নি। বিষয়টা এক দিক থেকে স্বস্তির। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ভয়ংকর একটা ক্ষতি এরই মধ্যে ঘটে গেছে, তা হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করছি না। মনে রাখা প্রয়োজন নৈরাজ্য সংক্রামক। এটা মারাত্মক ভাইরাসের মতো মানুষকে প্রভাবিত করে, প্রলুব্ধ করে। এতে নাগরিকদের মধ্যে আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়। বিপরীতে উৎসাহিত হয় সংঘাত ও সহিংসতা। পাঁচ আগস্টের পর থেকে কিছুটা বিরতি দিয়ে এই চর্চাই চলছে। যাতে ধ্বংস হচ্ছে মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ। তৈরি হচ্ছে আত্মঘাতী নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।

একটা কথা সবার মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান ইন্টারনেট যুগে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয়। বিশ্বের কোথায় কি হচ্ছে তা মানুষ মুহূর্তেই জানতে পারেন। ভিডিও দেখতে পারেন, অনেক সময় সরাসরিও দেখতে পারেন। একবার ভাবুনতো, বাংলাদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরেক বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিচ্ছে এই দৃশ্যগুলো বিশ্ববাসীর কাছে কী বার্তা দিচ্ছে? এতে কী বাংলাদেশের শিক্ষার্থী সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ইতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে? নাকি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা চিহ্নিত হচ্ছেন নৈরাজ্যকারী, দাঙ্গাবাজ হিসেবে? অনেকেই ভাবেতে পারেন এতে সমস্যা কী? সমস্যা আছে। সমস্যা হলো এতে বিদেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সুযোগ মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। ভিসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তৈরি হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা। এমনিতেই নানাবিধ কারণে বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে নিত্য-নতুন শর্ত আরোপ করছে বিভিন্ন দেশ। শুধু তাই নয় পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে নানা অপমাননজনক শর্ত জুড়িয়ে দিচ্ছে। জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের জন্য যা চরম অপমানজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানকে অনেকেই একজন বিবেকবান ও সংবেদনশীল শিক্ষক হিসেবে চেনেন। সিটি ইউনিভার্সিটি ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের আত্মবিনাশী এই সংঘাতের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বার্তায় তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন তুলেছেন, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাতভর মারামারি, সম্পদ ভাঙচুর চলে। পৃথিবীর কোথাও এমন শুনেছেন? ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজের মারামারি, ঢাকা কলেজ-আইডিয়াল কলেজের মারামারিতো আছেই। ঢাকা কলেজ-নিউমার্কেটের মারামারি, বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রামবাসীদের মধ্যে মারামারি এসব কোনো সভ্য দেশে সম্ভব?

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক। দুনিয়ার কোথাও এমন ঘৃণ্য বর্বর ঘটনা ঘটে না। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এমন নজির নেই। সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবযাপনে বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়েও এমন নজির নেই। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তবে এর আগেও শিক্ষাঙ্গনের অনেক সংঘাতের ঘটনাতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্র নিষ্ক্রিয় থেকেছে। যা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।

একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, শিক্ষাঙ্গণে যারা এসব নৈরাজ্য ও দাঙ্গাবাজি করছেন তারা সংখ্যায় বেশি নন। আমি বলব, খুব সামান্য; কিন্তু তারা ক্ষতিটা করছেন অনেক বড়, সুদূরপ্রসারী। যাতে দেশের শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে বহির্বিশ্বে অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে। আমার ধারণা, এই প্রভাব আগামী দিনগুলোতে অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে। এই নৈরাজ্য, অরাজতা ও ধ্বংসযজ্ঞের শেষ হওয়া প্রয়োজন। এমন আত্মবিনাশী ঘটনা আর নয়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদকিতা বভিাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ