দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ
চাঁদাবাজি নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি নিরেট সত্য কথা বলেছেন; কথাটি হচ্ছে চাঁদাবাজি এবং চাঁদার মাত্রা চব্বিশের ৫ আগস্টের পর বেড়েছে এবং চাঁজাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক কমিটমেন্ট প্রয়োজন। কারণ চাঁদাবাজ শুধু চাঁদাবাজই নয়, সে রাজনীতিও করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে তার সঙ্গে আমার সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত বলে তিনি একজন নির্লোভ ব্যক্তিও। পাকিস্তান আমলের সিএসপি আমলা, তাই দক্ষও। অর্থ উপদেষ্টা হয়েই তিনি বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা যত খারাপ বলা হয়, তত খারাপ নয়; কিন্তু ক্ষমতায় বসেই দলীয় সরকারের রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি হচ্ছে, আগের সরকারের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।
শ্বেতপত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু বিগত সরকারের অপকর্মের উন্মোচন নয়, বরং নিজেদের গলাবাজির ক্ষেত্র তৈরি করা, শ্বেতপত্র দেখিয়ে যেন বলতে পারে ‘আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু করেছি’। সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেছেন, ‘আমরা যেখানে হাত দেই সেখানেই দুর্নীতি আর দুর্নীতি! রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, পোকামাকড়ের মতো দুর্নীতি। এই অবস্থা শুধু ১৬ বছরের বিষয় নয়, এটা শত যুগ ধরে চলছে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আগে একটি দল চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী পাহারা দিত। সেই সিস্টেম ও চাঁদাবাজি এখন আরেকটি দল টিকিয়ে রাখছে’। ঘুষ আর দুর্নীতি থাকলে চাঁদাবাজিও থাকবে। আমার এক আত্মীয় ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, আশির দশকে তার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামের আনোয়ারায়, ওখানে চোরাচালানের রমরমা ব্যবসা। একদিন গভীর রাতে চোরাচালানের প্রচুর মালপত্র ধরা পড়ল, তিনি নিয়ম মেনে তালিকা করে জমা দিলেন। বড় কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে বললেন, ‘রব্বানি, মালপত্র কম কেন? আপনি যে তালিকা করেছেন তার কয়েকগুণ বেশি পণ্য নাকি ধরা হয়েছিল? বাকিগুলো কই?’ সততার বিপদ সর্বত্র। সৎ এবং ভালো মানুষ সংঘবদ্ধ নয়, ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক সমর্থন পায়, পায় বলেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বদিউর রহমানকে চাকুরি থেকে ইস্তফা দিতে হয়।
কিছুদিন আগে অর্থ উপদেষ্টা তার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সহকর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ঘুষ আর দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নিজের ঘুষ দেওয়ার কাহিনি উল্লেখ করেন। তিনি ঘুষ দিয়েছেন আয়কর বিভাগকেই, এখন তিনি সেই আয়কর বিভাগেরই মন্ত্রী বা উপদেষ্টা। আয়কর বিভাগকে ঘুষ না দিয়ে উপায় নেই, নতুবা আয়কর নথি থেকে সব দলিলপত্র উধাও হয়ে যায়। নালিশ করে লাভ নেই, দুদক কমিশনারও হজে যাওয়ার আগের দিন কোন একটি সংস্থাকে এক লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। আয়কর সংশ্লিষ্ট আইনকানুন অনেক জটিল এবং ভয়ংকর। ব্যবসায়ীরা আয়কর বিভাগের চেয়ে কাস্টমসকে বেশি তোয়াজ করে, কারণ বিভিন্ন অভিযোগ দিয়ে পণ্য ছাড়করণ বিলম্বিত করে দিতে পারলেই ডেমারেজ চার্জ কয়েক লাখ টাকা হয়ে যায়। অবশ্য অসৎ ব্যবসায়ীরা ঘুষখোর কর্মকর্তা পছন্দ করে, কারণ কাস্টম অফিসারদের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া অসৎ ব্যবসা করা যায় না।
সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও খারাপ, বিদ্যুৎ-গ্যাস চুরির ইতিহাস দীর্ঘ। দুর্নীতি কোথায় নেই! যে শিক্ষকদের আদর্শে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ার কথা, সেই শিক্ষকগণই প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষার খাতায় নম্বর কমিয়ে দেয়, আর যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের হাতে আগাম প্রশ্নপত্র তুলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি করে ছাত্র-শিক্ষক মিলে। বহু উপাচার্যকে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের দুর্নীতির কথা নিয়ে শত শত পৃষ্ঠার বই লেখা যাবে। ওষুধ ও চিকিৎসা জগতের দুর্নীতি নিয়ে বই লিখেছেন আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ড. মুনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মাসি বিভাগের অধ্যাপক এবং বর্তমানে ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষক। তিনি ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রো ভিসিও ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরোধিতার কারণে ড. মুনির উদ্দিন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে প্রেষণে যেতে পারেননি। ওষুধ প্রশাসনে তাকে কিছুদিনের জন্য বহাল করা হলে হয়তো মানবিহীন ওষুধ উৎপাদন কমত; কিন্তু সরকার ওষুধ কোম্পানির প্রেসারের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে প্রণীত ওষুধনীতির কারণে দেশের ওষুধ খাতে একটি বিপ্লব ঘটে, শত শত দেশীয় ওষুধ কোম্পানি গড়ে ওঠে। প্রেস ক্লাবের একটি সেমিনারে এই কথা বলার কারণে বিএনপির তৎকালীন নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ড. মুনির উদ্দিন আহমদের ওপর ক্ষেপে সেমিনার ত্যাগ করেছিলেন। দুর্নীতি বন্ধ হবে কী করে, রাজনীতিবিদরা সত্য কথাও সহ্য করতে পারেন না। জনগণ সম্পৃক্ত থাকায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি দেদীপ্যমান। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সারের পরীক্ষাও হয় না, করাতে হয় অন্যত্র। সব সরকারি হাসপাতালের একই অবস্থা, পরীক্ষা করার মেশিন ক্রয়ের পরদিন থেকেই নষ্ট, কেয়ামত পর্যন্ত আর মেরামত হয় না। মেরামত হলে প্রাইভেট ল্যাবরটরিগুলো থেকে কমিশন খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। এই দুর্নীতি তো নতুন নয়, নতুন বন্দোবস্ত এই দুর্নীতি বন্ধ করতে পারবে?
ডাক্তারদের বড় বিচ্যুতি হচ্ছে বিনা কারণে অপ্রয়োজনীয় টেস্টের সুপারিশ করা এবং তার বিনিময়ে ল্যাবরেটরির নিকট থেকে চুক্তিবদ্ধ কমিশন গ্রহণ করা। উপজেলা পর্যায়ে পোস্টিং পাওয়া বেশিরভাগ ডাক্তার কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সপ্তাহে দুই দিন থাকেন; সরকার বিষয়টি জানে, জেনেও অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। নামকরা ডাক্তারদের দুর্নীতি আকাশছোঁয়া। এরা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, কিন্তু কাজ করে প্রাইভেট ক্লিনিকে। সরকারি হাসপাতালের পদবিকে তারা বিক্রি করে রোগীকে আকৃষ্ট করে। তারা একেবারেই কর্মক্ষেত্রে আসেন না, তা কিন্তু ঠিক নয়, এক থেকে দেড় ঘণ্টার জন্য আসেন। কর্মক্ষেত্রে ঢুকেই দৌড়ের ওপর থাকেন, তার সহকর্মী ইন্টার্নি ডাক্তারগণও তার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে থাকেন, তারা জানেন, বড় ডাক্তারের জন্য ক্লিনিকে লাখ লাখ টাকার রোগী অপেক্ষায় বসে আছে। ডাক্তারদের নির্মিত এই সিস্টেমের সংস্কার করার ক্ষমতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন বন্দোবস্ত থাকার কথা নয়। কারণ এরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আনুকুল্য ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অমানুষ হয়েছে।’ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ’ এবং ‘ড্যাব’ বা ‘ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ জীবিত থাকলে স্বাস্থ্য খাত থেকে দুর্নীতি নির্মূল প্রায় অসম্ভব।
সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ই পূতপবিত্র নয়। সাংবাদিক, যাদের দুর্নীতির উদ্ঘাটন করার কথা, তাদের কেউ কেউ আবার দুর্নীতির ফাঁদ তৈরি করে থাকেন। মোড়লগিরি ও দুর্নীতি করার সুবিধার্থে ব্যাংকগুলো তদারকির জন্য ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি বিভাগ খুলে রাখা হয়েছে। এই বিভাগের অস্তিত্ব থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টার কথা শুনলে মনে হয়, কোন দুর্নীতিই হয়নি। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় বলছে, সব আইনকানুন মেনে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে আদানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
অন্যদিকে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেছেন, বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও এই চার্জ দিতে হবে, এটাই নিয়ম। যারা দুর্নীতি দমন করে, দুদক, তাদের সম্পর্কে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক এক চেয়ারম্যান দুর্নীতি অভিযোগ তুলেছিলেন। ব্যাংকে দুর্নীতি আছে বলেই লোন গণহারে খেলাপি হচ্ছে। ঋণের বিশৃঙ্খলার জন্য বুদ্ধিভ্রষ্ট তত্ত্বাবধান বা মনিটরিংও কম দায়ী নয়।
দুর্নীতির মূল কারণ দলীয়করণ। অঘা মন্ত্রী আর চতুর আমলার সমন্বয়ে দুর্নীতি হয় বেশি। যে আমলা এক সরকারে অতি আদরণীয়, সেই আমলাই ভিন্নতর দলীয় সরকারের নিকট অপাঙ্ক্তেয়, তখন নির্ধারিত নিয়তি হচ্ছে ওএসডি। আমলারা তা জানে এবং জানে বলেই সুযোগ পেলেই চুরি করে, দুর্নীতি করে, ঘুষ খায়। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই চাঁদাবাজির উপর শতভাগ নির্ভরশীল, সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করার রাজনৈতিক কমিটমেন্ট অর্থ উপদেষ্টা আশা করেন কী করে!
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে