কপ১১: তামাকের হাত থেকে ভবিষ্যৎ রক্ষায় বিশ্বের সাথে একাত্ম বাংলাদেশ
জেনেভায় শুরু হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (WHO FCTC) পক্ষসমূহের একাদশ সম্মেলন (COP11)। এফসিটিসি (WHO FCTC) একটি বৈশ্বিক চুক্তি, যা জনস্বাস্থ্যের গতিপথ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই সম্মেলেনে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জেনেভায় একত্রিত হয়েছে এমন এক জনস্বাস্থ্য হুমকির মোকাবিলায়, যা প্রতি বছর লাখো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সেটি হলো-তামাকের ব্যবহার।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমরা তামাক নিয়ন্ত্রণ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (WHO FCTC) সম্পর্কে একটু জেনে নিই। WHO FCTC হলো বিশ্বের প্রথম জনস্বাস্থ্য চুক্তি, যার পক্ষভুক্ত দেশ ১৮৩টি—এবং প্রায় দুই দশক ধরে এটি নিঃশব্দে কিন্তু শক্তিশালীভাবে জীবন রক্ষা করে আসছে। বাংলাদেশ এই চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। বিশ্বব্যাপী সিগারেটের প্যাকেটে শক্তিশালী স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা, ধূমপানমুক্ত জনসমাগমস্থান, উচ্চ তামাক কর এবং তরুণদের লক্ষ্য করে তামাক বিপণনে নিষেধাজ্ঞা—এসব নীতির বাস্তবায়ন হয়েছে WHO FCTC এর ফল হিসেবে।
WHO FCTC অনুসরণ করে যে দেশগুলো তামাক কর বৃদ্ধি করেছে এবং ঘরের ভেতরে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে, সেখানে ধূমপানের হার নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। যে দেশগুলো বিজ্ঞাপন ও প্রচারে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে, তারা তরুণ প্রজন্মকে আসক্তি থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। বৈশ্বিক ধূমপানের হার আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তাই লক্ষ্য একটাই—চুক্তিতে যে পদক্ষেপগুলো নির্ধারিত আছে, সেগুলো কার্যকর করা।
কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা খুব সহজ নয়। তামাক কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল বদলাচ্ছে। আজ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের মতো কোম্পানিগুলো ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকো এবং নিকোটিন পাউচকে ‘ক্ষতিহীন’ বলে প্রচার করে, অথচ আসক্তির প্রকৃত ঝুঁকি গোপন বা কমিয়ে দেখায়। এগুলো সেই একই কোম্পানি যারা দশকের পর দশক সিগারেটের ক্ষতি সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে—এবং যাদের জনস্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণে কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়।
বাংলাদেশে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করার জন্য জোরদার আন্দোলন চলছে, অপরদিকে দেখা যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলো সরকারকে প্রভাবিত করে তাদের সাথে বৈঠকের আয়োজন করছে। এমনকি নিয়ম লঙ্ঘন করে সরকার ফিলিপ মরিচের মত তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানিকে নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। অথচ তামাক কোম্পানির এসব হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্যই বাংলাদেশ WHO FCTC তো স্বাক্ষর করেছে।
এমতবস্থায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অঙ্গীকার আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আয়োজিত হচ্ছে এই COP11 সম্মেলন। বাংলাদেশও এই সম্মেলনের অংশগ্রহণকারী। এই সম্মেলন স্বাক্ষরকারী দেশের সরকারগুলোর জন্য আরেকবার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার সুযোগ—বিশেষ করে তরুণদের—বিশ্বের প্রধান প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর কারণ তামাকের ক্ষতি থেকে রক্ষার অঙ্গীকার। এটি কার্যকর নীতিগুলোকে আরও শক্তিশালী করার, ফাঁকফোকর বন্ধ করার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাক শিল্পের প্রভাবমুক্তভাবে বড় হতে দেওয়ার একটি সুযোগ।
বাংলাদেশের জন্য এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তামাক প্রতি বছর বিশ্বে ৮০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটায়, যার মধ্যে আমাদের দেশেও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Tobacco Atlas অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্রতিদিনের হিসাবে যা ৪৪২ জন। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (GATS 2017) অনুযায়ী, ধূমপান না করেও গণপরিবহন, রেস্টুরেন্ট ও পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানে আক্রান্ত হন ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা জরিপ ২০১৮ অনুযায়ী, তামাক খাত থেকে প্রতি বছর সরকার যেখানে রাজস্ব পায় ২২ হাজার কোটি টাকা, সেখানে তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ২৭% বেশি।
এই মৃতুর মিছিল ও অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধে এখন প্রয়োজন দ্রুততা, দৃঢ়তা এবং সক্রিয় পদক্ষেপ।
২০০৫ সালে প্রণীত (২০১৩ সালে সংশোধিত) বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও কার্যকর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে: পাবলিক প্লেস এবং গণপরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বাতিল করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, তামাকপণ্যের খুচরা ও মোড়কবিহীন বিক্রয় বন্ধ করা, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, সিগারেট ও অন্যান্য তামাকপণ্যের প্যাকেটের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করা এবং ই-সিগারেট বা ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশু-কিশোর ও তরুণদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এই COP11 সামনে রেখে জেনেভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রভাব ফেলবে। WHO FCTC-এর পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আমরা আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারি, জীবন বাঁচাতে পারি এবং সবার জন্য একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।
(লেখক: অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে