সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও প্রতিকার
সংবিধান একটি দেশের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। সংবিধান হচ্ছে সে সব মৌলিক নিয়মকানুন এবং প্রথার সমষ্টি যা কোনো রাষ্ট্রের সরকারের বিভিন্ন বিভাগ অর্থাৎ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে। শাসকের ক্ষমতা বর্ণনা করে, শাসিতের মৌলিক অধিকার বর্ণনা করে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে এবং শাসক তার ক্ষমতার গণ্ডি লঙ্ঘন করে শাসিতের অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে তার প্রতিবিধানের জন্য বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত হয় এবং এ সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে বলবৎ হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সংবিধান রয়েছে। তবে আমাদের সংবিধান লিখিত ও সংহিতাবদ্ধ এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকারের রূপরেখা বা কাঠামোসহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি, জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো, রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা, বিচার বিভাগের কার্যপরিধি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ামক বিধানাবলি। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, তার মধ্যে ‘অনুচ্ছেদ ৭(১) অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।
অনুচ্ছেদ ৭(২) অনুযায়ী জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এ সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, তা হলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, সংবিধান হলো কোনো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক একটি লিখিত দলিল। অন্যদিকে সাংবিধানিক আইন হলো দেশের সুশাসনের মূল নীতি ও পদ্ধতি। তা ছাড়া জনগণের মৌলিক অধিকারও সংবিধানের ২৬-৪৪ অনুচ্ছেদ দ্বারা সুরক্ষিত ও নিশ্চিত, যা আইনপ্রণেতারা কোনোরকম সংশোধন, পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারেন না এবং সাংবিধানিক অধিকার সাধারণত আইন দ্বারা রক্ষিত এবং আইনপ্রণেতারা এটিকে সংশোধন, পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারেন।
কারও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারেন। অন্যদিকে সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সাধারণ আদালতে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারেন। উল্লেখ্য, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে প্রতিকার প্রার্থনা করা যায় না। কারণ মৌলিক অধিকার নিজ দেশের নাগরিকের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য আর মানবাধিকার পৃথিবীর সব মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। রিট নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনায় এটা বলা যে, রিটের সর্ব প্রথম উৎপত্তি লাভ করে ইংল্যান্ডে এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এটি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।
প্রাথমিক অবস্থায় রিট ছিল রাজার বিশেষাধিকার। রাজা বা রানি ন্যায় বিচারের উৎস হিসেবে রিট জারি করতেন। পরবর্তী সময়ে রাজা বা রানীর প্রতিনিধি হিসেবে ইংল্যান্ডে দুধরনের আদালত গঠিত হয়। তা হলো চ্যান্সারি আদালত ও কিংস বেঞ্চ। এসব আদালতে একই ধরনের মামলা বারবার হতে থাকলে রিটের একটি সাধারণ আকৃতি প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্টের অধীন রাজা তৃতীয় জর্জ কর্তৃক ১৭৭৪ সারের ২৬ মার্চ ইস্যুকৃত রাজকীয় সনদের আওতায় কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে বিচারপতিকে ইংল্যান্ডের কিংস বেঞ্চের এখতিয়ার প্রদান করার মাধ্যমে এ উপমহাদেশে রিটের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিক্রমায় রিট আমাদের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে ‘কমন ল’ভুক্ত দেশের রিট প্রক্রিয়া একই ধরনের। রিট অর্থ লিখিত আদেশ যা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা প্রদান করতে পারেন।
সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ সংবিধানের তয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভিন্ন কোনো উপায় না থাকলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রিট দায়েরের মাধ্যমে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পরেন। প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলির সহিত সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনকারী কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রিট করা যায়; কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো প্রাইভেট ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিট করা যায় না। রিট সাধারণত ৫ প্রকার। যথা- ১। Writ of Mandamus (আদেশমূলক রিট) : সংবিধানের ১০২(২) (ক)(অ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কোনো কাজ করার জন্য নির্দেশ প্রদানকে Writ of Mandamus (আদেশমূলক রিট) বলা হয় ২) Writ of prohibition (নিষেধাজ্ঞামূলক রিট): সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা কর্তৃক বেআইনিভাবে কোনো কাজ না করার নির্দেশ প্রদানকে Writ of prohibition (নিষেধাজ্ঞামূলক রিট) বলা হয়।
৩) Writ of certiorari (উৎপ্রেষণমূলক রিট)- সংবিধানের ১০২(২) (ক)(আ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বেআইনিভাবে কৃত কোনো কাজের আইনগত কার্যকারিতা নাই মর্মে ঘোষণা করাকে Writ of certiorari (উৎপ্রেষণমূলক রিট) বলা হয়। ৪) Writ of habeas corpus (বন্দি প্রদর্শন রিট)-সংবিধানের ১০২(২) (খ)(অ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ বেআইনিভাবে কোনো ব্যক্তিকে আটক রাখা হয়নি তা নিশ্চিত হওয়ার লক্ষ্যে আটক ব্যক্তিকে হাইকোর্ট বিভাগে হাজির করানোর লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নির্দেশ প্রদান করাকে Writ of habeas corpus (বন্দি প্রদর্শন রিট) বলা হয়।
৫) Writ of Quo-warranto (কারণ দর্শাও রিট)-সংবিধানের ১০২(২)(খ)(আ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক কোনো ব্যক্তি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কোন ক্ষমতা বলে বা কর্তৃত্ব বলে অনুরূপ পদে বহাল আছে তা প্রদর্শনের নির্দেশ প্রদানকে Writ of Quo-warranto (কারণ দর্শাও রিট) বলা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, Writ of Mandamus (আদেশমূলক রিট), Writ of prohibition (নিষেধাজ্ঞামূলক রিট) ও Writ of certiorari (উৎপ্রেষণমূলক রিট) শুধু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি করতে পারে।
অন্যদিকে Writ of Mandamus (বন্দি প্রদর্শন রিট) ও Writ of Quo-warranto (কারণ দর্শাও রিট) যে কোনো ব্যক্তি করতে পারে। পরিশেষে এটুকু বলা যায় রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য থেকে দেশের সংবিধান মেনে চলা প্রত্যেক নাগরিকের যেমন পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থাকা।
মো. জে আর খান রবিন: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে