ঐকমত্য কমিশন: বিএনপি না মানলে কী হবে?
রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন; কিন্তু গত ১১ জুলাই কমিশনের বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য রাখার সিরিয়াল পাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তার প্রশ্ন, ‘বিএনপি কি ৫ নম্বর দল যে তাকে ৫ নম্বরে গিয়ে কথা বলতে হবে?’
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এদিন বৈঠকের পর কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলনের জন্য নির্ধারিত কক্ষে নেমে আসেন। প্রথমে কথা বলেন আলী রীয়াজ। এর পরপরই আসেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তখন পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ; কিন্তু জোনায়েদ সাকি উঠে যাওয়ার পরপরই সংবাদ সম্মেলনে বসে পড়েন ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন। তিনি বক্তব্য শুরু করে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলন না করেই চলে যেতে উদ্যত হন। নিজের গাড়িতে ওঠার সময় কয়েকজন সাংবাদিক তাকে সংবাদ সম্মেলনে আসার আহ্বান জানালে তিনি বলেন, ‘এখানে তো তোমরা সিরিয়ালই দিচ্ছ না, ছোট ছোট দল বসে পড়ে, এটা কোনো কথা? আমি চলে যাচ্ছি।’
এর অর্ধ মাস পর সোমবার (২৮ জুলাই) কমিশনের বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় দফা সংলাপের ২০তম দিন সকাল থেকে এজেন্ডা অনুযায়ী আলোচনা শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ওয়াকআউট করেন। দুপুর সোয়া ১২টায় তিনি আবার বৈঠকে যোগ দেন। এদিন সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় এবং ন্যায়পাল পদে সদস্য নিয়োগের প্রস্তাবিত বিধান নিয়ে আলোচনায় অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি।
প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়। পরে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই ছয়টি কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। সংস্কারের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর কাছ থেকে ছক আকারে মতামত নেয় ঐকমত্য কমিশন। এরপর ২০ মার্চ থেকে শুরু হয় দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা। এটি চলে ১৯ মে পর্যন্ত। গত ২ জুন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধন করেন।
প্রশ্ন হলো, বিএনপির মতো একটি বড় দল যদি কোনো একটি ইস্যুতে আলোচনা না করে বা করতে না চায় তাহলে সে বিষয়ে ঐকমত্য গঠন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে কি না? প্রশ্নটা উঠেছে এ কারণে যে, সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে কেবল বিএনপি এককভাবে অতীতে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। বাকি দলগুলোর মধ্যে জামায়াত সরকারের অংশ থাকলেও তারা এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। সুতরাং ২৯টি দল যদি কোনো বিষয়ে একমত হয় আর বিএনপি যদি একমত না হয় তাহলে কি ওই প্রস্তাবটি গৃহীত হবে না? কারণ গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে নেয়ার রেওয়াজ আছে।
এটা ঠিক যে, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিয়মকানুন ঠিক করার জন্য যাতে কেউ একতরফা সুযোগ না পায়। নির্বাচনটা যাতে ঠিকমতো হয়, সবাই নির্ভয়ে নিজের ভোট দিতে পারে তার ব্যবস্থা করতেই এসব আলোচনা। আবার ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো যেন আগের মতো না হয়ে যায়, সেই ব্যবস্থাও করা দরকার এবং কোনো একটি দল ক্ষমতায় এসেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যাতে যা খুশি করতে না পারে, সেটিও নিশ্চিত করা দরকার। সুতরাং বিএনপি একা যদি কোনো একটি বিষয়ে ভেটো দেয় বা মানতে না চায়, তাহলে কি সেটি গৃহীত হবে না?
কিন্তু মুশকিল হলো, রাষ্ট্র সংস্কার তথা নিয়মকানুন ঠিক করার দায়িত্ব যাদের তাদের যোগ্যতা, ইনটেনশন ও পক্ষপাতিত্ব নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সরকার যদি নিজের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে পারত তাহলে প্রশ্ন উঠতো না; কিন্তু জনগণের মধ্যে একটা পারসেপশন তৈরি হয়ে গেছে যে, এই সরকার আসলে নির্বাচন দিতে চায় না বা নির্বাচন করার মতো সক্ষমতাও তাদের নেই। এই ধরনের পারসেপশন তৈরি হওয়াটা কাম্য ছিল না। বরং দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সরকার হওয়ার কথা ছিল। তাছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার তথা অনেক বড় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে এমন সব দল ও পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যাদের অধিকাংশেরই জনভিত্তি নেই। জনগণ যাদের চেনে না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত তিনটি রাজনৈতিক দল (বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি) এককভাবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে ছিল; কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কার, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিবর্তনের মতো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য যে সংলাপ হচ্ছে সেখানে দেশের বড় দুটি দল অনুপস্থিত। অভ্যুত্থানের পর বাস্তবিক কারণে এই সংলাপে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি; কিন্তু অতীতে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় এই দুটি দলের ভোট কত? যদি এখনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং এই দুটি দল নির্বাচন করতে পারে তাহলে তারা কি অনেক ভোট পাবে না? যদি এই দুটি দলের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোটও থাকে তাহলে এই বিরাটসংখ্যক মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দুটি দলকে আলোচনার বাইরে রেখে কী করে জাতীয় ঐকমত্য হবে?
সুতরাং, এখন এই সংলাপে যেহেতু আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নেই ফলে এখানে বিএনপিই সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দল। তারা যদি কোনো একটি বিষয়ে যৌক্তিক কারণে ভিন্ন অবস্থানে থাকে, বাকি ২৯টি দল ও জোট একমত হয়েছে বলেই সেটা কার্যকর করা কঠিন। কারণ এখানে বিএনপিকে অন্য কোনো একটি দল বা একটি জোটের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ নেই। মেজরিটি কোনো একটি বিষয়ে একমত হলেই সেটা মানতে হবে, এটা সবসময় সঠিক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে মেজরিটির অংশ আসলে কারা? তাদের জনভিত্তি, জনপ্রিয়তা ও অভিজ্ঞতা কেমন?
আবার এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোট বা এই দুটি দলের প্রতি কত মানুষের সমর্থন আছে, সেটি সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া জানার আর কোনো উপায় নেই। সুতরাং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। মানুষ যাদের ভোট দেবে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো তারা নেবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ঐকমত্য কমিশন বা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের পলিসি ইস্যুতে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে কি না- সেটি বিরাট প্রশ্ন। জনগণ যদি জামায়াত বা এনসিপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনে তাহলে তাদের নেতৃত্বেই সিদ্ধান্ত হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অরাজনৈতিক লোকদের নেতৃত্বে হওয়াটা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।
অস্বীকার করা যাবে না, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাওয়া এবং সেটি খুব দ্রুত; কিন্তু এই মূল কাজটি না করে তারা সংস্কারের নামে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে এবং যেভাবে সময় নষ্ট করছে তাতে কোথাও কোনো সংস্কার তো হচ্ছেই না, বরং নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করে দিয়ে কিছু অদক্ষ লোকের শাসনকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।
বিএনপি বা অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলেই লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে- এটি নিশ্চিত করে বলা না গেলেও রাষ্ট্র একটি পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশন, অতএব এর পরিচালনার ভার রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকতে হবে। দেশ পরিচালনা সুশীল সমাজের কাজ নয়। তাদের কাজ পরামর্শ দেয়া। সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া।
জুলাই সনদ নিয়ে কী হবে
সোমবারের ওয়াকআউটের বিষয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে এমপিরা ভোট দেয়ার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। ঐকমত্য পোষণ তো হচ্ছেই। এখন যদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সব প্রস্তাবে আমাদের শতভাগ একমত হতে বলে তাহলে আলোচনার জন্য ডাকা হলো কেন?’
ঐক্যের প্রক্রিয়া নিয়ে শুধু বিএনপি নয়, আরও একাধিক দল আপত্তি জানিয়েছে। সম্প্রতি গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেছেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে তাতে কতটা ঐকমত্য হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’
বলা হচ্ছে, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেই বিষয়গুলো যুক্ত করে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ সই হবে; কিন্তু বিএনপি যেদিন ওয়াকআউট করলো সেদিনই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আনুপাতিক পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে না এলে জুলাই সনদে তারা স্বাক্ষর করবেন কি না- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে উচ্চকক্ষ, আমরা বলেছিলাম উচ্চকক্ষটি ভোটার অনুপাতে হতে হবে, পিআর অনুসারে হতে হবে। এই উচ্চকক্ষ আমাদের ক্ষমতার ভারসাম্য ও জবাবদিহির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই বিষয়ে এখনো ঐকমত্য আসেনি। এ বিষয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্য না এলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর হবে কিনা আমাদের সন্দেহ আছে।’
তার মানে এনসিপি যেভাবে চাইবে- সেভাবেই জুলাই সনদ লিখতে হবে, অন্যথায় তারা স্বাক্ষর করবে না? আর যদি তারা যেভাবে চায় সেভাবেই জুলাই সনদ লেখা হয় তাহলে বিএনপিসহ অন্য সব দল কি তা মেনে নেবে? ধরা যাক সব দল মেনে নিল; কিন্তু বিএনপি একা মানলো না, তখন কী হবে? ফলে এটা ধারণা করা অমূলক নয় যে, জুলাই সনদ ইস্যুতে শিগগিরই রাজনীতির জল ঘোলা হতে পারে।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে