রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক আর প্রশ্ন
রাজধানীজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, মানুষের চোখে আতঙ্ক আর মুখে প্রশ্ন। গতকাল উত্তরা দিয়াবাড়ি এলাকায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে গোটা নগরীর আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ৩১ জন নিহত এবং ১৬৫ জন আহত হয়েছেন।
এই বিভীষিকাময় ঘটনার রেশ না কাটতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় ছাত্র বিক্ষোভ। মাইলস্টোন কলেজের ঘটনার শোকে কাতর শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, ২২ জুলাইয়ের এইচএসসি পরীক্ষা যেন পিছিয়ে দেয়া হয়। সোমবার দিবাগত রাত ৩টার আগ পর্যন্ত সরকার এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না দেয়ায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
অন্যদিকে, মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, নিহত ও আহতদের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করা হচ্ছে। শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ‘মিথ্যাচারের’ প্রতিবাদ জানিয়ে তারা ২৩ জুলাই সকাল থেকেই কলেজ চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিমান বিধ্বস্তের স্থান পরিদর্শনে গেলে শিক্ষার্থীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হন।
একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আহত হন অন্তত তিন শিক্ষার্থী। এতেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সচিবালয় পর্যন্ত। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েন। এখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লাঠিচার্জে আহত হন অন্তত ৮০ জন।
এসব ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠে রাজধানীবাসী। সন্ধ্যার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মূল সড়কগুলো ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাট মূলত ফাঁকা। ফলে, রাজধানীর রাজপথে এখন বিরাজ করছে থমথমে এক অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে।
পথেই ভিউজ বাংলাদেশ-এর কথা হয় চাকরিজীবী এবং একজন শিক্ষার্থীর মা সানজিদার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাতে নিরাপত্তার জন্য আমরা সন্তানদের ঘর থেকেও বের করতে ভয় পাচ্ছি।’
এদিকে মাইলস্টোন কলেজের নিহত শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল হাসনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আহত, কেউ নিহত, কেউ নিখোঁজ। এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দেয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই।’
আবার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নিহত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কেন খোলাখুলিভাবে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের দাবি, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানানো হোক।
ঢাকার একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা ফাহমিদা আক্তার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করার কোনো মানে হয় না। রাষ্ট্রের উচিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সত্যকে স্বীকার করা।’
এদিকে সচিবালয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে রাজপথের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল ট্রাফিক বিভাগ। এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি যেন নগরবাসীকে পুরোপুরি স্থবিরতায় না পড়তে হয়। ডাইভারশনের মাধ্যমে যানবাহনের রুট পরিবর্তন করে স্বাভাবিক গতিতে ট্রাফিক সচল রাখার সর্বাত্মক প্রয়াস চালানো হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, কিছু কিছু এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়েছে চালকদের, তবে বড় ধরনের জট কিংবা বিপর্যয় এড়াতে সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করেছে ট্রাফিক বিভাগ।
রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকাল থেকেই তৎপর ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সড়কে, মোড়ে মোড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সামনে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান জানান, ‘ঘটনার পর থেকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশ। রাজধানীর কোথাও যাতে অস্থিতিশীলতা না ছড়ায়, সে জন্য আমাদের সদস্যরা মাঠে সক্রিয় ছিলেন শুরু থেকেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ ধৈর্য ও পেশাদারিত্ব বজায় রেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছি। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন আমাদের অগ্রাধিকার।’ নগরজুড়ে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে