কর্মের মধ্যে কমরেড যতীন সরকার বেঁচে থাকবেন
অধ্যাপক যতীন সরকার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি তেমন বিত্তবান ঘরের সন্তান ছিলেন না; কিন্তু জ্ঞানের ঐশ্বর্যে তিনি ছিলেন বিত্তবান। ছিলেন প্রান্তজন। ছোটবেলা থেকেই খুব কষ্ট করে বড় হয়েছেন। লেখাপড়াও করেছেন খুব কষ্টের মধ্যে; কিন্তু চিন্তার দিক থেকে তিনি যখন মার্কসবাদ চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত হন, তখন তার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়। আমৃত্যু তিনি মার্কসবাদ, লেলিনবাদী দর্শনে বিশ্বাস করতেন; কিন্তু চর্চার দিক থেকে তিনি ছিলেন লোকজ।
চর্চার দিক থেকে তিনি কোনো ডগমেটিক ছিলেন না। মতান্ধ ছিলেন না। নতুনকে ধারণ করার ক্ষমতা ওনার মধ্যে ছিল প্রবল।বাংলাদেশের সমাজ, এই ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজটা তিনি খুব গভীরভাবে দেখেছেন। বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। আমাদের পার্টির বিভিন্ন চর্চাকেন্দ্রে, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে তিনি খুব সহজে একাত্ম হয়ে যেতে পারতেন।
যতীন সরকারের আলোচনা শুনে নবীন-প্রবীণ সবাই খুব আপ্লুত হতেন। গর্ভাচেভ-পিরিয়ডে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমস্ত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ের সময় আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে মার্কসাবাদ লেনিনবাদ চর্চাকারীদের মধ্যেও আদর্শের চির ধরে। তখনো যতীন সরকার আমাদের সঙ্গে লড়াইয়ে শামিল ছিলেন।
এ নিয়ে তিনি বারবার লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, মার্কসবাদ হলো গতির দর্শন। গতির কোনো শেষ নেই। তাই মার্কসবাদ সব সময়ই নতুনকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। তিনি বলেছেন, চেঞ্জ ইজ আনচেঞ্জেবল। পরিবর্তনকে কখনো পরিবর্তন করা যায় না। এই যে চেঞ্জ ইজ আনচেঞ্জেবল এটা মার্কসবাদেরই কথা। পরিবর্তন যদি হতে থাকে সেটাকে পেছন দিকে আনা যায় না। পরিবর্তন সব সময়ই সামনের দিকে আগায়। যদিও ইতিহাসে কখনো কখনো পশ্চাৎগতি থাকে। সে পশ্চাৎগতি কোনো চিরস্থায়ী ব্যাপার না। যতীন সরকার এই দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলি, আমাদের দেশে এখন একটু পশ্চাৎগতি চলছে। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা, সেই ১৯৪৭-এর ধ্যান-ধারণা ফিরে আসছে। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে যে দেশভাগ হয়েছে, ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে তুলেছি, সেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তির মধ্যেই নিহিত ছিল ধর্মনিরপেক্ষকতা, যার ভিত্তিতে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, এবং যে- চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে আমাদের সংবিধান প্রণয়ন করেছি এখন সেটাকে রুখে দেয়ার এক ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটাই হলো ইতিহাসের একটা পশ্চাৎগতি।
যতীন সরকার বলতেন, পশ্চাৎগতি আছে, তবে, পশ্চাৎগতি কোনো স্থায়ী ব্যাপার না। আজকে বাংলাদেশে যে পশ্চাৎগতি চলছে সেটাও কোনো স্থায়ী ব্যাপার না। তিনি একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন। সৃজনশীল মার্কসাবাদী ছিলেন। যান্ত্রিকভাবে মার্কসবাদ চর্চা করতেন না। নিজের বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের ক্রিটিক করেই তিনি মার্কসবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। এ নিয়ে তার বহু লেখা আছে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে তার লেখা পড়তে হবে, বুঝতে হবে।
তার লেখা পড়লে তাদের জীবনদৃষ্টি স্বচ্ছ হবে। তার লেখা পড়লে তারা জীবনের কর্তব্য স্থির করতে পারবে। আজকে যতীন সরকারকে আমরা হারিয়েছি; কিন্তু তার সৃষ্টিশীল কর্ম আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। তার কর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের কমরেড যতীন সরকার বেঁচে থাকবেন।
মোহাম্মদ শাহ আলম: সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে