পুরোনো বন্দোবস্তে ‘স্বস্তির ঈদযাত্রা’
উন্নয়নকর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুন বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিকেল ৪টার দিকে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অস্বাভাবিক জ্যামে আর ধৈর্য পেলাম না! গাজীপুর হয়ে ফিরে এলাম! ঈদ ঢাকাতেই করছি।’ এর কিছুক্ষণ পরে যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক মাহফুজ মিশু লিখেছেন, ‘বিকেল ৫টার দিকে বাড়িতে পৌঁছালাম। ভোর সাড়ে ৫টায় রওনা করেছি। গাবতলী পার হতেই সাড়ে ৭টা। তারপর কালিয়াকৈর আসতে ১০টা। রাস্তায় গাড়ির চাপ, মানুষের আধিক্য তো আছেই। যেটা নাই, সেটা ব্যবস্থাপনা।
পুলিশ আছে; কিন্তু গা-ছাড়া। কী ভয়ানক, অনিরাপদ যাত্রা। বলতে পারেন, সব মানুষ একসঙ্গে গেলে এমন হবেই। সেটা সত্যও বটে; কিন্তু এত দীর্ঘ ছুটি। যে কারণে দেয়া হলো যেন স্বস্তিদায়ক হয় ঈদযাত্রা। অথচ ঈদের আগে ছুটি মাত্র দুদিন। সব ছুটি পরে। ফলে রাস্তায় আজ ও আগামীকাল যে তীব্র ভোগান্তি হবে, হচ্ছে মানুষের সেটা কর্তাদের অদূরদর্শিতার ফল। তারপরও মায়ের কাছে যাই, নিজের গ্রামে।’
তার এই পোস্টের নিচে একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক শাহনাজ শারমীন লেখেন, ‘ভোর সাড়ে ৫ টায় রওনা হয়ে ঢাকা ছেড়ে পদ্মা সেতুতে আসতে সাড়ে ৮টা বেজে গেল। এতক্ষণে বাসায় থাকার কথা বাগেরহাটে।’ এদিন একটি টেলিভিশনের খবরে দেখানো হয়, ভিড়ের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে রাজধানীর সদরঘাটে লঞ্চে উঠতে গিয়ে পুরো একটি পরিবার নদীতে পড়ে যায়। তাদের মধ্যে একটি শিশুও ছিল। সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চ থেকে বয়া ফেলার কারণে পরিবারটি বেঁচে যায়।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে। মূলত বিকেল ৪টা থেকে এই জ্যাম শুরু হয়। যাত্রীরা জানান, টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তায় আসতেই তাদের প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে।
এদিন একটি অনলাইন পোর্টালের খবরের শিরোনাম, ‘খোলা ট্রাক-পিকআপ ভ্যানে ঈদযাত্রা; রোদের পর বৃষ্টিতে ভিজে অস্বস্তি।’ খবরে বলা হয়, ঈদ উদযাপন করতে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন মানুষ। এতে তীব্র যানজটের পাশাপাশি প্রচণ্ড রোদের পর মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে অস্বস্তিতে পড়েছেন ঘরমুখো মানুষ।
একই দিন সিনিয়র সাংবাদিক আবু সালেহ আকন ফেসবুকে লেখেন: ‘বিভিন্ন টার্মিনালে হয়রানি চলছে। দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। দয়া করে ব্যবস্থা নিন।’ প্রতি বছরের দুটি ঈদে এই দৃশ্য ও অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের চিরচেনা। আমি নিজেও একবার খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে পান্থপথ থেকে তিন ঘণ্টায়ও সদরঘাটে পৌঁছাতে না পেরে মাঝপথ থেকে বাসায় ফিরে আসি। ঢাকাতেই ঈদ করতে হয়।
২.
ঈদযাত্রায় এই ভোগান্তি এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, কোনো বছর এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেই বরং মানুষ বিস্মিত হয়। আবার সব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরাই একই ভাষায় কথা বলেন। আশ্বাস দেন। যেমন গত বুধবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। উপদেষ্টা বলেন, ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখতে সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। যথা সময়ে ট্রেন চলাচল নিশ্চিতে শিডিউল মতো ট্রেন আসা-যাওয়া করছে। এর জন্য সবাই মিলে কাজ করছে।
এটা ঠিক যে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের খবর পাওয়া যায়নি; কিন্তু ট্রেনের মূল সমস্যা হচ্ছে টিকিটের সংকট। এখন শত ভাগ টিকিট দেওয়া হয় অনলাইনে এবং টিকিট ছাড়া হয় যাত্রার ১০ দিন আগে; কিন্তু তারপরও টিকিট ছাড়ার কিছু সময়ের মধ্যে অধিকাংশ টিকিট শেষ হয়ে যায়। আবার একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষ সিস্টেমে প্রবেশ করায় সার্ভার ডাউন হয়ে যায়। ফলে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট পাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।
প্রশ্ন হলো, ট্রেনের সংখ্যা কেন বাড়ানো হয় না? সারা বছরই ট্রেনে যাত্রীর চাপ থাকে। অনলাইনে যাত্রার ১০ দিন আগে চেষ্টা করেও অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া যায় না। সুতরাং যে পরিবহনে যাত্রীদের এত চাপ, এত চাহিদা, তার উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা কী? যে হারে রাস্তা, ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণ হয়, সেই তুলনায় রেলের উন্নয়ন কেন এত কম? দাতারা রেলের উন্নয়নে পয়সা দিতে চায় না বলে? দাতারা না দিক, নিজস্ব অর্থায়নে কেন ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো হয় না?
৩.
পদ্মা সেতু হওয়ার আগ পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ঈদযাত্রায় একটি বড় আতঙ্কের নাম ছিল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও মাওয়া-কাওড়াকান্দি ফেরি। পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার যে কষ্ট, সেটি যারা না দেখেছেন, তাদের বোঝানো কঠিন। দক্ষিণের মানুষের সেই কষ্ট ঘুচিয়েছে পদ্মা সেতু। এখন ঢাকা থেকে অসংখ্য বাস প্রতিনিয়ত দক্ষিণের জেলাগুলোয় যায়; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ঢাকা শহর থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যায়; বিশেষ করে ঈদের সময়। আবার এক্সপ্রেসওয়ের পরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জেলাগুলোর রাস্তা এখনো তুলনামূলকভাবে কম প্রশস্ত।
ফলে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি যতটা দ্রুত চলতে পারে, ভাঙার পরে আর সেটি পারে না। উপরন্তু এই রুটে দুর্ঘটনা নিত্যকার ঘটনা। পদ্মা সেতু হলেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনো বিরাট ভরসার নাম লঞ্চ। সদরঘাট থেকে এখনো প্রতিদিন অনেক লঞ্চ ছেড়ে যায়; কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে ঢাকা-বরিশাল রুটে লঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা স্বাভাবিক সময়ে খুব বেশি যাত্রী পাওয়া যায় না। অধিকাংশ লোক সড়কপথেই যাতায়াত করে। ফলে ঈদের সময় যে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়, লঞ্চগুলো তা সামাল দিতে পারে না।
আবার শুধু দুটি ঈদ সামনে রেখে লঞ্চের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়। তাছাড়া দুই ঈদেই দেখা যায়, গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পৌঁছাতে এক ঘণ্টা বা কখনো দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। পুরান ঢাকার রাস্তাঘাট এমনিতেই সরু। সারা বছরই সদরঘাটে যেতে যানজট পোহাতে হয়; কিন্তু ঈদের সময় মানুষ ও যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ সামাল দেওয়ার জন্য কি বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
৪.
দেশে গত বছরের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর থেকে যে শব্দগুলো জনপরিসরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে তার অন্যতম ‘নতুন বন্দোবস্ত’। অর্থাৎ যারা এই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন, তারা দেশের বিদ্যমান ও পুরোনো ব্যবস্থা বাতিল করে নতুন রাজনীতি, নতুন প্রশাসন, নতুন চিন্তা ও দর্শনের মধ্য দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার জন্য নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছেন। গত প্রায় ১০ মাস ধরেই এই কথা শোনা যাচ্ছে; কিন্তু দেশের রাজনীতি, প্রশাসনসহ কোথাও কোনো নতুন বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দৃশ্যমান নয়। সবই আগের মতোই চলছে। ফুটপাত থেকে কোরবানির পশুর হাট- সর্বত্র চাঁদাবাজি আগের মতোই চলছে। শুধু ব্যক্তি ও দলের পরিবর্তন হয়েছে।
প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতি- কোথাও ইতিবাচক পরিবর্তনের কোনো আওয়াজ নেই। সবই পুরোনো বন্দোবস্তের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ঈদযাত্রায়ও তা-ই। প্রতি বছর ঈদের সময় রাজধানী ঢাকা থেকে অর্ধ কোটির বেশি মানুষ যে বাড়িতে যাবে, এই কথাটি সরকার জানে; কিন্তু সেই জানা সত্ত্বেও মহাসড়কে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে কী ব্যবস্থা নেয়? এবারও আব্দুল্লাহ আল মামুনের আরও কত মানুষ মাঝপথ থেকে ফিরে এসেছেন- সেই সংখ্যাটি কি আমরা জানি? বাড়িতে বাবা-মা আত্মীয়-পরিজন অপেক্ষায়। অথচ তাদের মাঝপথ থেকে ফিরে আসতে হলো। এই ব্যর্থতায় দায় কি রাষ্ট্র নেবে?
সাংবাদিক মাহফুজ মিশু লিখেছেন, সড়কে গাড়ির চাপ ও মানুষের অধিক্য আছে; কিন্তু নেই ব্যবস্থাপনা। পুলিশের গা-ছাড়া ভাব। তার মানে এটা তো সেই পুরোনো বন্দোবস্তই। অভ্যুত্থান-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের মানুষ তো এই দৃশ্যই দেখেছে। তাহলে একটি বিরাট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একজন নোবেলজয়ীর নেতৃত্বে যে নির্দলীয় সরকারটি গঠিত হলো, তারা সেই পুরোনো বন্দোবস্ত বা পুরোনো সিস্টেম বদলে মানুষের জীবন স্বস্তিদায়ক করতে কী পদক্ষেপ নিলো- সেই প্রশ্ন তোলাই কি সংগত নয়?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে